এখন অনেকেই একটি কমন কারণে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে সমস্যায় আছেন, এটি হলো বাচ্চাদের পড়ানো। “বাচ্চারা পড়া মনে রাখতে পারে না”, এই কথা অনেকেরই। বাচ্চাদের পড়া মনে রাখার কৌশলগুলো যদি আপনি রপ্ত করতে পারেন, তাহলে আর সমস্যা হবে না।
আজ আমরা এই লেখায়, বাচ্চাদের পড়া মনে রাখার কৌশলগুলোই আলোচনা করবো। কীভাবে বাচ্চারা সহজেই পড়া মনে রাখতে পারবে, কীভাবে বোঝালে তাদের মস্তিষ্কে সহজেই তা ধারন হয়ে যাবে সে সম্পর্কে।
আমরা বেশ অনেকগুলো পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করেছি। একেক বাচ্চার ক্ষেত্রে হয়তো একেকটা কৌশল কাজ করতে পারে। সুতরাং, আপনি পরীক্ষা করে দেখুন আপনার বাচ্চার ক্ষেত্রে কোনটি কাজ করে।
লেখার সূচিপত্র
বাচ্চাদের পড়া মনে রাখার কৌশল
১. বাচ্চাকে বুঝিয়ে পড়ান
প্রতিটি সাবজেক্ট আপনার বাচ্চাকে বুঝিয়ে পড়ান। তাকে এটাও বলুন যে, মুখস্থ পড়া কখনো সামনে এগিয়ে যেতে দেয়না। এসব বিষয় ছোট থেকেই তার মাথায় ঢুকলে পড়ে এমনিতেই বাচ্চা বুঝে যাবে।
২. ছবির মাধ্যমে পড়ান
আপনি যখন আপনার বাচ্চাকে পড়াবেন তখন বিভিন্ন ধরনের ছবির সাহায্য নিন। ছবির সাহায্য নিয়ে পড়ালে তারা পড়ার সাথে ছবিটিও মস্তিষ্কে ধারন করবে। তাই, এটি মনেও থাকবে অনেকদিন। ধরুন, আপনি আপনার বাচ্চাকে পড়ালেন,
- বাঘ = Tiger. এসময় আপনি বাচ্চাকে বাঘের ছবিও দেখাবেন। কারণ, আপনি যদি বাচ্চাকে বাঘের ছবিটিও দেখান তাহলে সে প্রানীটিকেও চিনতে পারবে। অর্থটাও তার মনে থাকবে, এবং এটা সে সহজে ভুলে যাবে না।
আপনি ছবি দেখানোর জন্য কোনো পেপার কাটিং বা বই ব্যবহার করতে পারেন। আর তা সম্ভব না হলে, আপনার মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। বাচ্চাদের পড়া মনে রাখার কৌশল হিসাবে এটা বেশ কাজ করে।
৩. রং ব্যবহার করুন
বাচ্চাকে রং এর মাধ্যমে পড়ান। আপনি যদি বাচ্চাকে কোনো কিছু পড়ান, তখন তার পাশে বিভিন্ন রং ব্যবহার করুন। এতে আপনি বিষয় সম্পর্কিত রং ব্যবহার করতে পারেন।
- যেমন – আপনি বাচ্চাকে গাছ সম্পর্কে পড়াচ্ছেন। এখন সেখানে সবুজ রং দিয়ে লিখুন, “গাছ = Tree”। এতে গাছের পাতার রং সবুজ এটাও তার মনে থাকবে।
৪. গল্পের সাহায্যে পড়ান
আপনার বাচ্চাকে যখন কোনো কিছু সম্পর্কে বোঝাতে যাবেন, তখন কোনো গল্পের সাহায্য নিন। কারণ, বাচ্চারা গল্প শুনতে পছন্দ করে। এটা তারা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তাই, এটা তাদের মনেও থাকবে।
আপনি যে বিষয়ে তাকে পড়াচ্ছেন, সে বিষয় সম্পর্কিত গল্প বলুন। ছোট গল্প বলবেন, তা যেন রূপকথার হয়। খরগোশ সম্পর্কে পড়ালে, তাকে খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড়ের গল্পটা শুনিয়ে দিতে পারেন।
৫. খেলনার সাহায্য নিন
আপনার বাচ্চাকে পড়ালে খেলনার সাহায্য নিয়ে পড়াতে পারেন। মনে করুন, আপনি তাকে যোগ বিয়োগ এর অঙ্ক শেখাচ্ছেন। ২ + ৩ = ৫। এ বিষয়টি তাকে খেলনা দিয়ে বোঝনাোর জন্য একজাতীয় যেকোনো কিছুর সাহায্য নিতে পারেন।
- যেমন – প্রথমে তাকে ২ টি খেলনা আপেল দিলেন। এরপর আবার ৩ টি আপেল দিলেন। এবার তাকে গুনতে বললেন। এরকম ভাবে বোঝালে তার বুঝতে তেমন সময় লাগবে না।
৬. আঙুলের সাহায্য নিন
আপনার বাচ্চাকে গনিত পড়ানোর সময় তার হাতের আঙুল ব্যবহার করতে বলুন। গনিতে তার ১ থেকে ৫ গননা, হাতের আঙুলের মাধ্যমে শেখান। এরপর তাকে ১ + ৩ সমান কত হয় তা বলতে বললে দেখবেন সে তার হাতের আঙুলের সাহায্যই আপনাকে সংখ্যাটি বলে দিতে সক্ষম হয়েছে।
৭. সংখ্যার সাহায্যে বস্তুর উদাহরণ দিন
এই বিষয়টি একটু অন্যরকম। যেমন- আপনি তাকে ৮ = আট, 8 = Eight এটা পড়ালেন। তাহলে, তাকে এটাও বলুন সৌরজগৎ এ গ্রহের সংখ্যা আট। এতে গ্রহ কয়টি এটাও সে বুঝে যাবে আর সংখ্যাটাও তার মনে থাকবে, এ সম্পর্কে ধারনাও থাকবে।
৮. বাচ্চার কাছে জানুন
আপনি আপনার বাচ্চাকে পড়ানোর পর তাকে বলবেন, আপনাকে পড়াতে। আপনি আপনার বাচ্চাকে যে বিষয়গুলো একবার পড়িয়েছেন, সে বিষয়গুলো যেন সে আবার আপনাকে পড়ায় অর্থাৎ আপনাকে বুঝিয়ে দেয়। এতে সে যদি এটা করতে পারে তার মানে পড়াটুকু তার মনে আছে।
আর, যদি না পারে, তবে তাকে আবার পড়ান এবং এরপর আবার আপনাকে বুঝিয়ে দিতে বলুন। এতে একসময় এমনিতেই তার মাথায় পড়াটা ঢুকে যাবে। বাচ্চাদের পড়া মনে রাখার কৌশল হিসাবে এটাও বেশ কার্যকরী।
৯. গুছিয়ে নিয়ে পড়ান
বাচ্চাকে পড়ানোর আগে কোনো একটি অধ্যায়কে প্রথমে কয়েকটি শাখায় ভাগ করে নিন। এরপর একেক সময় একেক পার্ট পড়ান। এতে সে অধ্যায়ের বিষয়বস্তুগুলো সম্পর্কেও সে ধারনা পাবে আর পড়া মনে রাখতে পারবে।
১০. ছক করে নিন
যখন কোনো একটি অধ্যায় বা পাঠ পড়াবেন তখন কিছু একজাতীয় লাইন অগোছালো থাকতেই পারে। তখন একটি খাতায় ছক করে সব ধারাবাহিকভাবে তুলবেন। এতে বাচ্চা সেই ছক দেখে একত্রে বিষয়গুলো পড়তে পারবে। ফলে পড়া মনে রাখতে কষ্ট হবে না।
১১. ছক করে দেয়ালে টানিয়ে রাখুন
কোনো বিষয়ভিত্তিক ছক তৈরি করে তা দেয়ালে টানান। এতে বারবার তার দিকে চোখ পড়লে বাচ্চা সহজেই বিষয়টি বুঝে যাবে, এবং অনেকদিন মনে থাকবে।
১২. তাকে নিজে নিজে লিখতে বলুন
একটি বিষয়বস্তু পড়ানো হয়ে গেলে তাকে বলুন, নিজের মতো করে সেটা আপনাকে আবার বলতে বা নিজের মতো করে তা লিখতে। এতে বোঝা যাবে সে কতটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। আর লিখতে দিলে সে যদি নিজের মতো করে লিখতে চেষ্টা করে তাহলে, এ সম্পর্কে তার একটা ধারনা আসবে। ফলে সবটুকু পড়া তার খুব সহজেই মনে থাকবে।
১৩. রুটিন তৈরি করুন
বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য রুটিন তৈরি করে দিন। শুধু পড়ার জন্য নয়, সকালের ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের রুটিন তৈরি করুন। কোন সময়টুকু তার পড়ার জন্য আর কোন সময়টুকু খেলার জন্য এটা তাকে বুঝিয়ে বলুন।
প্রতিদিন একই সময়ে পড়াশোনা করলে তার মস্তিষ্কে সেই সময়ে কাজ করার প্রক্রিয়া বেড়ে যাবে। তাই পড়াও তার খুব ভালোভাব মনে থাকবে। সকালবেলার পড়া মাথায় দ্রুত প্রবেশ করে। এসময় পড়ানো উত্তম। দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরির নিয়ম লেখাটি পড়লেই বুঝতে পারবেন।
১৪. পুষ্টিকর খাদ্য দিন
বাচ্চার ব্রেইনের জন্য অবশ্যই তার পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন আছে। দৈনিক তার খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে ১ টি ডিম ও ১ গ্লাস দুধ রাখুন। তাকে মাছ মাংস খওয়ানোর পাশাপাশি শাক-সবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাইরের খাবারের দিকে আকৃষ্ট করবেন না। কারণ, বাইরের খাবারে কিছু ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে।
১৫. পরিমিত ঘুম
বাচ্চাকে পরিমিত ঘুমের সুযোগ দিন। খুব বেশি বা খুব কম যেন না হয়। শরীরে ক্লান্তি অনুভব করলে সাথে সাথে বিশ্রামের সুযোগ করে দিন। কারণ ঘুমের তারতম্যের কারণেও বাচ্চার মস্তিষ্কের তথ্য ধারন ক্ষমতার উলোট-পালোট হয়ে যেতে পারে। যা তার পড়া মনে রাখায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
১৬. একটানা পড়াবেন না
অনেকে বাচ্চাকে একটানা অনেকক্ষণ পড়ান। এতে বাচ্চার একঘেয়েমি চলে আসে। এটা তাকে পরবর্তী পড়ায় মনোযোগ দিতে বাধা দেয়। তাই, একটানা না পড়িয়ে তাকে একটু একটু করে পড়ান। ১ ঘন্টা টানা পড়াবেন না। ৪০ মিনিট পড়িয়ে ১৫ মিনিট রেস্ট দিন। আাবার ২৫ মিনিট পড়িয়ে ৫ মিনিট করে রেস্ট দিলেও তা তার মাথায় থাকবে।
১৭. ইলেকট্রনিক ডিভাইস কম ব্যবহার করতে দিন
বাচ্চাদের পড়া মনে রাখার কৌশল এর অন্যতম একটি কৌশল হলো, তাকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে দেবেন না। তবে, আপনি তাকে ভালো কোনো ভিডিও দেখাতে পারেন। শিক্ষামূলক কিছু দেখাতে পারেন।
দিনে আধ ঘন্টার বেশি কখনোই একটা বাচ্চাকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে দেয়া উচিত নয়। তাকে কখনই বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস দেয়া যাবে না।এতে সে এসবের প্রতি অ্যাডিক্টেড হয়ে যেতে পারে। এমনকি আপনি নিজেও কম ব্যবহার করুন। কারণ আপনাকে দেখেই বাচ্চা শিখবে। আপনি ফেসবুকে আসক্ত হলে, ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় লেখাটি পড়তে পারেন।
১৮. মার্ক করে পড়ান
আপনার বাচ্চাকে পড়ানোর সময় বিভিন্ন মার্কার পেন ব্যবাহর করতে পারেন। আপনি যখন তাকে পড়াবেন তখন এক একটি লাইন একেক কালার মার্কার পেন দিয়ে মার্ক করে রাখুন। এতে সে সহজেই পড়াগুলো বারবার রিভাইজ করতে পারবে আর মনে রাখবে।
১৯. পড়াটি তাকে বারবার রিভাইজ করতে দিন
আপনি যখন তাকে পড়াটি পড়াবেন, তাকে তা বারবার রিভিশন দিতে উৎসাহ দিন। এতে তার পড়া মনে থাকবে। একটা পড়া বরবার রিভাইজ করলে তা খুব সহজেই আয়ত্তে চলে আসবে।
২০. পড়াশোনায় শাসন করবেন না
বাচ্চা পড়ায় ভুল করলে তাকে শাসন করবেন না। বরং তাকে তা আবার বুঝিয়ে দিন। কারণ আপনি তাকে শাসন করলে তার মনে আঘাত পেতে পারে। এতে তার মাথায় পরে সহজে পড়া ঢুকতে চাইবে না। তাই শাসন না করে বুঝিয়ে বলুন। তবে বাচ্চা যদি বহিরাগত কোনো ভুল বারবার করে তবে, তাকে তা না করার জন্য কিছুটা শাসন করতে হবে।
২১. বিভিন্নভাবে শেখান
মানুষ সবদিক থেকে শিক্ষা পায়। এমনকি প্রকৃতি থেকেও। তাকে প্রকৃতিতে ছাড়ুন, পরিবেশ উপভোগ করতে দিন, আকাশ দেখতে দিন, গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখতে দিন, নদীর পানির শীতলতা অনুভব করতে দিন। কারণ বাচ্চার মন যদি ফুরফুরে থাকে তবে, সে অবশ্যই পড়াশোনায় মনোযোগ বসাতে পারবে।
তার পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। এতে সে অনেকভাবে শেখার সুযোগ পায়, অ্যানিমেটেড লেসন এ তাদের আকর্ষণ থাকবে, তাই সহজেই পড়া মনে রাখতে পারবে।
২২. বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়তে দিন
বাচ্চাকে বাইরের রূপকথার, গোয়েন্দা, থ্রিলার বই পড়তে দিন। একসময় এমনিতেই সে তাহলে বইয়ের পোকা হয়ে যাবে। শিশুদের জন্য পত্রিকার আয়োজনগুলো তাকে পড়তে দিন৷ বিভিন্ন ম্যাগজিত পড়তে দিন। এগুলো তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়। “কিশোর আলো” ম্যাগাজিন এর মধ্যে অন্যতম। আবৃত্তি, বিতর্ক এসব বিষয়েও তাকে থাকতে দিন। এগুলো স্কিল ডেভেলপমেন্ট এ সাহায্য করে।
পরিশষে
বাচ্চাকে অন্তত একটি কথা বোঝাবেন- পড়াশোনা ভালো ফলাফল করার জন্য নয়, ভালো একজন মানুষ হওয়ার জন্য। তাই পড়া একটু দেরীতে হলেও তাকে বুঝতে দিতে হবে। সবাই সমান বুদ্ধি নিয়ে জন্মায়নি। তবে, সবার মধ্যেই অনন্য কিছু একটা থাকে। সেটা খুঁজে পেতে তাকে সাহায্যে করুন।
আর খুব বেশী পড়াশোনার চাপ দিয়ে, বাচ্চার সুন্দর শৈশব নষ্ট করবেন না। তাকে খেলাধূলা কিংবা আনন্দদায়ক কাজ করার সময় দিন।