যদিও বাংলা আমাদের মাতৃভাষা কিন্তু, বাংলা ব্যকারণের নাম শুনলে অনেকের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আসলে, বাংলা ব্যাকরণে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমরা অনেকেই বুঝি না। আর বুঝলেও মনে রাখতে পারি না।
এই যেমন ধরুন উপসর্গ। স্কুলে থাকতে যেমন সমস্য হতো উপসর্গ মনে রাখা নিয়ে। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি পরীক্ষাতেও উপসর্গ মনে রাখা জরুরি হয়ে যায়। তবে যদি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল জানা থাকে তাহলে, এই সমস্যায় পড়তে হয় না।
লেখার সূচিপত্র
উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
উপসর্গ কী?
উপসর্গ বাংলা ব্যাকরণের খুব পরিচিত একটি নাম। কিছু অব্যয়সূচক শব্দাংশ আছে, যেগুলো অর্থহীন তবে অর্থ- দ্যোতক। এগুলো শব্দের অর্থের সংকোচন, প্রসারন, অন্য কোনো পরিবর্তন সাধন করে নতুন শব্দ গঠন করে, তাকে বলা হয় উপসর্গ।
ধরি, দেশ একটি উপসর্গ – একে যদি শব্দের পরে বসানো হয় তবে পাওয়া যায়- আদেশ, বিদেশ, উপদেশ।
উপসর্গের প্রকারভেদ
উপসর্গ ৩ ধরনের। যথা:
- সংস্কৃত উপসর্গ
- বাংলা উপসর্গ
- বিদেশি উপসর্গ
এদের মধ্যে সংস্কৃত উপসর্গ ২০ টি, বাংলা উপসর্গ ২১ টি। এই দুই ধরনের উপসর্গের মধ্যে ৪ টি কমন রয়েছে। অর্থাৎ এমন চারটি উপসর্গ যারা সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ক্ষেত্রে আছে।
এই চারটি হলো- বি, নি, সু, আ।
অনেক সময় বাংলা কয়টি এবং সংস্কৃত কয়টি তাও গরমিল হয়ে যায়। এজন্যও একটি ছন্দ আছে। এক্ষেত্রে বলা যায় “বাংলার মানুষ কথা বলে বেশি।”
আর এ থেকেই বোঝা যায় বাংলা উপসর্গও বেশি। মানে বাংলা ২১ হলে, সংস্কৃত ২০ টি।
খাঁটি বাংলা উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
এদের সংখ্যা ২১ টি। যথা: অ, অঘা, অজ, অনা, আ, আড়, আন, আব, ইতি, উন, কদ,, কু, নি, পাতি, বি, ভর, রাম, স, সা, সু, হা।
উদাহরন:
- অ = অচেনা, অজানা
- অঘা = অঘারাম
- অজ = অজপুকুর
- অনা = অনাবৃষ্টি
- আ = আকাঠা
- আড় = আড়চোখে
- আন = আনমনা
- আব = আবছায়া
- ইতি = ইতিহাস
- ঊন = ঊনিশ
- কদ = কদাকার
- কু = কুনজর
- নি = নিখুঁত
- পাতি = পাতিলেবু
- বি = বিফল
- ভর = ভরপেট
- রাম = রামদা
- স = সরব
- সা = সাজোয়ান
- সু = সুনজর
- হা = হাপিত্যেশ
উপরে কতগুলো উপসর্গ নিশ্চয় দেখেছেন। এখন এগুলো মনে রাখা নিশ্চয় অসম্ভব মনে হচ্ছে! কোন সমস্যা নেই। আপনি নিচের চিঠিটা মুখস্ত করে ফেলেন।
সুহাস,
প্রথমেই আদর নিবি। তুই তো জানিসই, তুই আমাদের এই অজপাড়াগাঁয়ের একমাত্র আশা আর ভরসা। আর শোন, কিছু মানুষের অনাচার, কুকথা আর ঐ আড়চোখে তাকানো কে কিন্ত মোটেও পাত্তা দিবি না। তোর জন্য আবরার ঊনত্রিশ টি পাতিলেবু সাথে কয়েকটি কদবেল পাঠিয়েছে। অচেনা জায়গায় গিয়েছিস। আনমনে হয়ে থাকলে খাবি। ভালো লাগবে।
ইতি
অঘারাম
চিঠি পড়া শেষ আশা করি। এবার দেখুন ম্যাজিক। চিঠির প্রতিটি শব্দের মধ্যেই আছে উপসর্গগুলো।
সু (সু), হা (হা), স (স),
প্রথমেই আদর (আ) নি (নি) বি (বি)। তুই তো জানিসই, তুই আমাদের এই অজপাড়াগাঁয়ের (অজ) একমাত্র আশা আর ভরসা (ভর) (সা)। আর শোন, কিছু মানুষের অনাচার (অনা), কুকথা (কু) আর ঐ আড়চোখে (আড়) তাকানো কে কিন্ত মোটেও পাত্তা দিবি না। তোর জন্য আবরার (আব) ঊনত্রিশ (ঊন) টি পাতিলেবু (পাতি) সাথে কয়েকটি কদবেল (কদ) পাঠিয়েছে। অচেনা (অ) জায়গায় গিয়েছিস। আনমনে (আন) হয়ে থাকলে খাবি। ভালো লাগবে।
ইতি (ইতি)
অঘারাম (অঘা) (রাম)
বাংলা উপসর্গ দিয়ে কিছু বাক্যে
- ইতিহাস যে কথা কয়।
- আমি অবেলাতে দিলাম পাড়ি অথৈ সায়রে।
- ভরদুপুরে তুমি কোথায় যাও?
- এতদিন কোথায় গিয়ে নিখোঁজ হয়ে ছিলে?
সংস্কৃত উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
সংস্কৃত উপসর্গকে তৎসম উপসর্গও বলা হয়। এদের সংখ্যা হলো ২০ টি।
প্র, পরা, অপ, সম, নি, অনু, অব, নির, দুর, বি, অধি, সু, উৎ, পরি, প্রতি, অতি, অপি, অভি, উপ, আ।
উদাহরন:
- প্র = প্রভাব, প্রচলন
- পরা = পরাজয়
- অপ = অপমান
- সম = সম্পূর্ণ
- নি = নিষেধ
- অনু = অনুতাপ
- অব = অবরোধ
- নির = নির্ভর
- দুর = দুর্নাম
- বি = বিফল
- অধি = অধিকার
- সু = সুকন্যা
- উৎ = উন্নতি, উৎক্ষিপ্ত
- পরি = পরিশেষ
- প্রতি = প্রতিধ্বনি
- অতি = অতিবৃষ্টি
- অপি = অপিনিহিত
- অভি = অভিমুখ
- উপ = উপবন
- আ= আভাস
নিচের চিঠিটা মুখস্ত করে ফেলুন।
প্রিয় প্রভাস,
পরাজয়, অপমানের সম্মুখীন না হয়ে এগিয়ে যাও। নিজে অবহেলা অনুভব করো না। নির্ভয়ে দুর্গম পথ এগোও। বিশুদ্ধ মনে সুচরিত্র উৎপন্ন হয়। অধিকার পরিপূর্ণ কর। প্রতিটি ভালো কাজ উপভোগ কর।
অতি ভাল থেকো। আজ আর নয়।
ইতি
অপি
এবার দেখুন, চিঠির প্রতিটি শব্দের মধ্যেই আছে উপরের সংস্কৃত উপসর্গগুলো।
প্রিয় প্রভাস (প্র),
পরাজয় (পর), অপমানের (অপ), সম্মুখীন (সম্) না হয়ে এগিয়ে যাও। নিজে (নি) অবহেলা (অব) অনুভব (অনু) করো না। নির্ভয়ে (নির) দুর্গম (দুর) পথ এগোও। বিশুদ্ধ (বি) মনে সুচরিত্র (সু) উৎপন্ন (উৎ) হয়। অধিকার (অধি) পরিপূর্ণ (পরি) কর। প্রতিটি (প্রতি) ভালো কাজ উপভোগ (উপ) কর।
অতি (অতি) ভাল থেকো। আজ (আ) আর নয়।
ইতি
অপি (অপি)
সংস্কৃত উপসর্গ দিয়ে কিছু বাক্যে
- সমাগত সুধীজন।
- তাদেরকে সাদর অভিনন্দন জানানো হলো।
- বর্গের পরিসীমার সূত্র মনে রেখো।
- অনেক দিন তার সাথে চিঠি আদান প্রদান হয় না।
বিদেশি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
বিদেশি উপসর্গ গুলোর মধ্যেও আছে প্রকারভেদ।
- ফারসি উপসর্গ
- আরবি উপসর্গ
- ইংরেজী উপসর্গ
- হিন্দি- উর্দু উপসর্গ
এই চার ধরনই বিদেশি উপসর্গের অন্তর্ভুক্ত।
ফরাসি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
ফরাসি উপসর্গ ১০ টি। এরা হলো- কার্, দর্, না, নিম্, ফি, বদ্, বে বর্, ব, কম্।
উদাহরণ:
- কার্ = কারখানা, কারবার
- দর্ = দরদালান, দরপাট্টা
- না = নারাজ, নাখোশ
- নিম্ = নিমরাজি
- ফি = ফি-রোজ, ফি-মাস
- বদ্ = বদনাম, বদহজম
- বে = বেতার, বেকার
- ব = বনাম, বকলম
- কম্ = কমজোর, কমবখ্ত
মনে রাখর কৌশল
কারখানা তে গিয়ে কিছুর দরদাম না করাই ভালো।
- কারখানা (কার্) তে গিয়ে কিছুর দরদাম (দর্) না (না) করাই ভালো।
নিমি ফিরোজার বান্ধবী।
- নিমি (নিম্) ফিরোজার (ফি) বান্ধবী।
বদস্বভাব আর বেয়াদবি দুটোই তার মধ্যে আছে।
- বদস্বভাব (বদ্) র বেয়াদবি (বে) দুটোই তার মধ্যে আছে।
মিলির বর বোকা কম।
- মিলির বর (বর) বোকা (ব) কম (কম্)
ফরাসি উপসর্গ দিয়ে কিছু বাক্যে
- কারখানা গিয়েছিলে কখন?
- তার অনেক বদমেজাজ।
- ছেলেটা বেকার।
- আজ ইন্ডিয়া বনাম পাকিস্তান এর ম্যাচ আছে।
আরবি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
আরবি উপসর্গের সংখ্যা ৪ টি। এরা হলো- আম, খাস, লা, গর্।
উদাহরণ:
- আম্ = আমদরবার, আমমোক্তার
- খাস্ = খাসমহল
- লা = লাজওয়াব, লাপাত্তা
- গর্ = গরমিল, গররাজি
মনে রাখর কৌশল
আমদরবার এবং খাসমহল এই দুই জায়গাতেই মন্ত্রী গরমিল করে লাপাত্তা।
- আমদরবার (আম্) এবং খাসমহল (খাস) এই দুই জায়গাতেই মন্ত্রী গরমিল (গর্) করে লাপাত্তা (লা)।
আরবি উপসর্গ দিয়ে কিছু বাক্যে
- হিসেবে গরমিল করো না।
- কোথায় লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে?
ইংরেজি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
ইংরেজী উপসর্গ ৪ টি। এরা হলো- ফুল, হাফ, হেড, সাব
উদাহরণ:
- ফুল = ফুল হাতা, ফুল বাবু
- হাফ = হাফ হাতা, হাফ টিকেট
- হেড = হেড মাস্টার, হেড অফিস
- সাব = সাব অফিস, সাব ইনস্পেকটর
মনে রাখার কৌশল
“ফুল -বাবু হাফ -টিকেট কেটে ট্রেনে করে হেড- অফিস এ সাব- ইনস্পেকটর এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন।”
- ফুল -বাবু (ফুল) হাফ -টিকেট (হাফ) কেটে ট্রেনে করে হেড- অফিস (হেড) এ সাব- ইনস্পেকটর (সাব) এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন।
ইংরেজী উপসর্গ দিয়ে কিছু বাক্যে
- হেড মাস্টার এর কাছে যাও।
উর্দু – হিন্দি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল
এর সংখ্যা মাত্র ১ টি। হর।
উদাহরণ: হরহামেশা
এটি মনে রাখতে কৌশল এর দরকার হয় না। কারন, ‘হর’ শব্দটুকু মনে রাখলেই হলো। আর যদি তাও মনে না তাকে তবে ভগ্নাংশের কথা মনে করবেন। কারন, ভগ্নাংশের উপরে লব ও নিচে হর অবস্থান করে।
তাহলেই “হর” শব্দটা মনে পড়বে।
এ উপসর্গ দিয়ে কিছু বাক্যে
- হরহামেশা এক কাজ করো না।
পরিশেষে
এই ছিল আমাদের উপসর্গ মনে রাখার কৌশল নিয়ে আজকের আলোচনা। এই লেখাতে উপসর্গ কী, তার প্রকারভেদ, কী কী, বাক্যে প্রয়োগ, উদাহরণ আর সাথে সহজে মনে রাখার কৌশল সম্পর্কে সহজভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি, লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে আর কাজে আসবে।