বাংলা ব্যাকরণ পড়েছেন আর সমাসের নাম শুনেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই সমাস নিয়ে কত কাহিনী যে, আমাদের স্কুল জীবনে রয়েছে তার তো কোন ইয়াত্তা নেই। হয়তো, স্কুল জীবনে এই সমাস মনে রাখার কৌশলগুলো জানা থাকলে, জীবনটা আরও সহজ হয়ে যেতে।
তবে, আপনি যদি এখন, স্কুলে পড়ে থাকেন আর আমাদের এই লেখাটি পড়েন। তাহলে, বলা যায় আপনি সৌভাগ্যবান। কারণ, কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সরকারি চাকরিতেও এই সমাস লাগবে। সুতরাং, আজকের এই সমাস মনে রাখার কৌশলগুলো মনে রাখলে আজীবন কাজে লাগবে৷
লেখার সূচিপত্র
সমাস কি?
প্রথমেই জেনে নিতে হবে সমাস কি। সমাস শব্দের অর্থ একাধিক পদের একপদীকরণ। এর মানে ১ এর বেশি শব্দ একত্রে মিলে একটি শব্দ গঠন করা। যেসকল শব্দ অর্থসম্বন্ধ, তেমন একাধিক শব্দ একসাথে যুক্ত হয়ে নতুন একটি শব্দ গঠন করে। এই প্রক্রিয়াটিকে সমাস বলা হয়।
উদাহরণ:
- বই ও পুস্তক = বইপুস্তক
- মহান যে নবী = মহানবী
এই যে আমরা বইপুস্তক বলি এটা কিন্তু দেখতে ১টি শব্দ মনে হলেও, আসলে ২টি শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে। আসলে, এটাই সমাস। সমাস মূলত এসেছে সংস্কৃত থেকে। তবে, কিছু কিছু সমাস খাঁটি বাংলারও অন্তর্ভুক্ত, যা সংস্কৃতের কোনো নিয়ম মানে না।
সমাস কত প্রকার?
সমাস প্রধানত ৬ প্রকার। তবে কিছু অপ্রধান সমাসও আছে। ৬ প্রকার সমাস হলো:
- দ্বন্দ্ব সমাস
- কর্মধারয় সমাস
- তৎপুরুষ সমাস
- বহুব্রীহি সমাস
- দ্বিগু সমাস
- অব্যয়ীভাব সমাস
(উল্লেখ্য, কেউ কেউ দ্বন্দ্ব সমাসকে কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং কর্মধারয় সমাসকে তৎপুরুষের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।)
অপ্রধান সমাস মূলত তিন ধরনের।
- প্রাদি সমাস
- নিত্য সমাস
- অলুক সমাস
সমাস মনে রাখার কৌশল
১. দ্বন্দ্ব সমাস মনে রাখার কৌশল
যে সমাসে প্রতিটি সমস্যমান পদের অর্থের সমান প্রাধান্য থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।
(সমস্যমান পদ- সমাসবদ্ধ পদটির অন্তর্গত পদগুলোকে সমস্যমান পদ বলা হয়।)
উদাহরণ,
তাল ও তমাল = তালতমাল
দ্বন্দ্ব সমাস মনে রাখার ছন্দ
ও, আর, এবং যেখানে, দ্বন্দ্ব সমাস সেখানে।
দ্বন্দ্ব সমাসে “ও, আর, এবং” এই তিনটি ব্যবহার করা হয়।
দ্বন্দ্ব সমাসেরও কিছু প্রকারভেদ আছে। তা মনে রাখার কৌশল:
মিলন বীরু ডাক্তারের বাড়িতে গেল। তার হাতের অঙ্গে সামান্য সংখ্যক ক্ষতের দাগ সমানতালে বেড়েই চলেছে। এমন সময় সৌম্যদের বাড়ির সহচরের সর্বনাম, ক্রিয়া, ক্রিয়া বিশেষণ ও বিশেষণ নিয়ে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল।
- মিলন: মিলনার্থক শব্দযোগে – চা-বিস্কুট
- বীরু: বিরোধার্থক শব্দযোগে – অহি-নকুল
- বাড়িতে: বিপরীতার্থক শব্দযোগে – আয়-ব্যায়
- অঙ্গে: অঙ্গবাচক শব্দযোগে – হাত-পাম
- সংখ্যাক: সংখ্যাবাচক শব্দযোগে – নয়-ছয়
- সমানতালে: সমার্থক শব্দযোগে – খাতা-পত্র
- সৌম্যদের বাড়ির সহচরের: প্রায় সমার্থক ও সহচর শব্দযোগে – দয়া-মায়া
- সর্বনাম: দুটি সর্বনামযোগে – যা-তা
- ক্রিয়া: দুটি ক্রিয়াযোগে – দেখা-শোনা
- ক্রিয়া বিশেষণ: দুটি ক্রিয়া বিশেষণযোগে – ধীরে-সুস্থে
- বিশেষণ: দুটি বিশেষণযোগে – কম-বেশি
২. কর্মধারয় সমাস মনে রাখার কৌশল
যে সমাসে বিশেষণ বা বিশেষণভাবাপন্ন পদের সাথে বিশেষ্য কিংবা বিশেষ্যভাবাপন্ন পদের সমাস হয়, পরপদের অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে।
উদাহরণ,
যে চালাক সেই চতুরঃ চালাক-চতুর
“যে, যিনি, যেটি, যেটা, তিনি, অথচ”- এগুলো থাকলে বুঝতে হবে যে এটি কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত।
কর্মধারয় সমাসের প্রকারভেদ চারটি।
- মধ্যপদলোপী
- উপমান
- উপমিত
- রূপক কর্মধারয় সমাস।
মনে রাখার কৌশল
মধ্য উপমহাদেশে উপম ও রূপক থাকে।
- মধ্যঃ মধ্যপদলোপী সমাস- সিংহ চিহ্নিত আসন- সিংহাসন
- উপমহাদেশেঃ উপমান কর্মধারয় – তুষারের ন্যায় শুভ্র – তুষারশুভ্র
- উপমঃ উপমিত কর্মধারয় – মুখ চন্দ্রের ন্যায় – চন্দ্রমুখ
- রূপকঃ রূপক কর্মধারয় – মন রূপ মাঝি – মনমাঝি।

৩. তৎপুরুষ সমাস মনে রাখার কৌশল
পূর্বপদের বিভক্তির লোপ পেলে যে সমাস হয় এবং যে সমাসে পরপদের অর্থ প্রধানভাবে বোঝায় তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে।
মনে রাখার ছন্দ
বিভক্তি যেখানে লোপ পাবে, সেখানে তৎপুরুষ সমাস হবে।
তৎপুরুষ সমাস নয় ধরনের।
মনে রাখার কৌশল
২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, উপলুক
- ২. দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাসঃ “কে, রে”, এই দুইটি ব্যবহার করা হয়। (দুঃখকে প্রাপ্ত – দুঃখপ্রাপ্ত)
- ৩. তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাসঃ “দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক” এই ৩ টি ব্যবহার করা হয়। (মন দিয়ে গড়া = মনগড়া)
- ৪. চতুর্থ তৎপুরুষ সমাসঃ “কে, জন্য, নিমিত্ত” এই ৩ টি ব্যবহার করা হয়। (বসতের নিমিত্ত বাড়ি = বসতবাড়ি)
- ৫. পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাসঃ “হতে, থেকে” এই দুইটি ব্যবহার করা হয়। (খাঁচা হতে ছাড়া = খাঁচাছাড়া)
- ৬. ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসঃ”র, এর” এই ২ টি ব্যবহার করা হয়। (চায়ের বাগান = চাবাগান)
- ৭. সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসঃ “এ, য়, তে” এই ৩ টি ব্যবহৃত হয়। (গাছে পাকা = গাছপাকা)
- ৯. নঞ্ তৎপুরুষ সমাসঃ “না, নেই, নাই, নয়” এই ৪ টি ব্যবহৃত হয়। (ন আচার = অনাচার)
- উপ. উপপদ তৎপুরুষ সমাসঃ জলে চরে যা- জলচর
- লুক. অলুক তৎপুরুষ সমাসঃ ঘিয়ে ভাজা = ঘিয়েভাজা।
৪. বহুব্রীহি সমাস মনে রাখার কৌশল
বহুব্রীহি সমাস নয় প্রকার।
মনে রাখার কৌশল
সমানতালে একটি ব্যাধি ব্যাতিহারে নয় গ্রামের মধ্যে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অলৌকিক সংখ্যকভাবে বেড়ে চলেছে। নিপাত যাক এ রোগ।
- সমানতালে: সমানাধিকরন বহুব্রীহি- (খোশ মেজাজ যার – খোশমেজাজ)
- একটি ব্যাধি: ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি – কথ সর্বস্ব যার – কথাসর্বস্ব
- ব্যাতিহারে: ব্যাতিহার বহুব্রীহি – হাতে হাতে যে যুদ্ধ – হাতাহাতি
- নয় গ্রামের: নঞ্ বহুব্রীহি – নি (নাই) ভুল যার – নির্ভূল
- মধ্যে ও: মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি – হাতে খড়ি দেয়া হয় যে অনুষ্ঠানে – হাতেখড়ি
- প্রত্যন্ত অঞ্চলে: প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি – ঘরের দিকে মুখ যার – ঘরমুখো
- অলৌকিক: অলুক বহুব্রীহি – হাতে ছড়ি যার- হাতে-ছড়ি
- সংখ্যকভাবে: সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি – চৌ চাল যে ঘরের – চৌচালানিপাত – নিপাতনে সিদ্ধ – দু দিকে অপ যার – দ্বীপ
৫. দ্বিগু সমাস মনে রাখার কৌশল”
থাকে যেখানে “সমাহার” দ্বিগু পাশে থাকে তার।”
মূলত, সমাহার অর্থে সংখ্যাবাচক শব্দের সাথে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয়, তাকে বলা হয় দ্বিগু সমাস।দ্বিগু সমাসে সর্বাবস্থায় সমাহার শব্দটি থাকবেই।
উদাহরণ,
চার রাস্তার সমাহার = চৌরাস্তাশত
অব্দের সমাহার = শতাব্দী
৬. অব্যয়ীভব সমাস মনে রাখার কৌশল
পূর্বপদে অব্যয়যোগে নিষ্পন্ন সমাসে যদি অব্যয়েরই অর্থের প্রাধান্য থাকে, তখন তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে।
সাবিতা তার অভাব থাকা পর্যন্ত অন্য কারো সদৃশ অনতিক্রম্যতা অতিক্রান্ত করে জীবনের বিরুদ্ধে পশ্চাৎ-এ ঈষৎ গমনও করেনি। ক্ষুদ্র ও অপূর্ণ এই জীবনে অভাব তো দূর তাকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
- সাঃ সামীপ্য; কন্ঠের সমীপে – উপকন্ঠ
- বিতাঃ বিপসা; দিন দিন = প্রতিদিন
- তার অভাবঃ অভাব; আমিষের অভাব = নিরামিষ
- থাকা পর্যন্তঃ পর্যন্ত; সমুদ্র থেকে হিমালয় পর্যন্ত = আসমুদ্রহিমাচল
- অন্য কারো সদৃশঃ সাদৃশ্য; শহরের সদৃশ = উপশহর
- অনতিক্রম্যতাঃ অনতিক্রম্যতা; রীতিকে অতিক্রম না করে = যথারীতি
- অতিক্রান্ত করেঃ অতিক্রান্ত; বেলাকে অতিক্রান্ত; উদ্বেল
- জীবনের বিরুদ্ধেঃ বিরোধ; বিরুদ্ধ বাদ = প্রতিবাদ
- পশ্চাৎ-এঃ পশ্চাৎ; পশ্চাৎ গমন = অনুগমন
- ঈষৎ গমনও করেনিঃ ঈষৎ; ঈষৎ নত = আনত
- ক্ষুদ্রঃ ক্ষুদ্র অর্থে; উপগ্রহ
- ও অপূর্ণঃ পূর্ণ বা সমগ্র অর্থে; পরিপূর্ণ
- এই জীবনে অভাব তো দূরঃ দূরবর্তী অর্থে; অক্ষির অগোচরে = পরোক্ষ
- তাকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনিঃ প্রতিনিধি অর্থে; প্রতিচ্ছবি
- কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাঃ প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থে; প্রতিপক্ষ
প্রাদি সমাস মনে রাখার কৌশল
প্র, প্রতি, অনু, পরি থাকে যেথায়, প্রাদি সমাসের উপস্থিতি পাবে সেথায়।
উদাহরণ,
প্র যে বচন = প্রবচন অনুতে যে তাপ = অনুতাপ
পরিশেষে
এই ছিল আমাদের আজকের আলোচনা। লেখাটিতে সহজভাবে সবটুকু উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে ও কাজে আসবে। আর যারা, উপসর্গ পারেন না, তারা উপসর্গ মনে রাখার কৌশল লেখাটি পড়তে পারেন।
Alhamdulillah sir vloi lekcen🥰
ধন্যবাদ