ডিজেল ইঞ্জিনের নাম শুনলেই প্রথমে আসে, ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে? বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিন গাড়ি থেকে ট্রাক, ট্রেন, জাহাজ এবং পাওয়ার জেনারেটরের মতো বিভিন্ন যানবাহন এবং মেশিনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
আপনার ডিজেল ইঞ্জিনের সাথে সম্পর্ক থাকুক কিংবা না থাকুক ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে এটা জানা জরুরি। আজকের এই লেখায় ডিজেল ইঞ্জিন কাজ করা নিয়ে বিস্তারিত বলার চেষ্টা করবো।
লেখার সূচিপত্র
ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে?
ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে এটা জানার আগে ডিজেল ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশের নামগুলো আগে জেনে নিতে হবে। যন্ত্রাংশগুলোর নাম জানার পর আমরা বিস্তারিত ব্যাখ্যাতে যাবো।
ডিজেল ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশের নাম
একটি ডিজেল ইঞ্জিন সঠিকভাবে কাজ করার জন্য এর ভিতরে বিভিন্ন পার্টস রয়েছে। যেমন:
১. সিলিন্ডার ব্লক

সিলিন্ডার ব্লক হলো ইঞ্জিনের প্রধান অংশ, যেখানে সিলিন্ডার গুলো রাখা হয়। এটি ঢালাই লোহা বা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি। ইঞ্জিনের উচ্চ তাপমাত্রা এবং চাপ সহ্য করার জন্য এটি ডিজাইন করা হয়েছে।
২. সিলিন্ডার হেড

সিলিন্ডার হেড সিলিন্ডার ব্লকের উপরে বসে এবং এতে জালানী চেম্বার, ভালভ ও অন্যান্য উপাদান থাকে। এটি সাধারণত ঢালাই লোহা বা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি। সিলিন্ডার ব্লকে বোল্ট করা হয়ে থাকে।
৩. পিস্টন

পিস্টন একটি নলাকার উপাদান যা সিলিন্ডারের ভিতরে সবসময় উপরে এবং নীচে চলতে থাকে। এটি একটি সংযোগকারী রডের মাধ্যমে ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টের সাথে সংযুক্ত থাকে এবং জ্বালানীর দ্বারা উৎপন্ন শক্তিকে ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টে স্থানান্তর করে।
৪. কানেক্টিং রড

কানেক্টিং রড পিস্টনকে ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টের সাথে সংযুক্ত করে এবং পিস্টনের পারস্পরিক গতিকে ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টের ঘূর্ণন গতিতে রূপান্তরিত করে ডিজেল ইঞ্জিন পরিচালনায় সহায়তা করে।
৫. ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট

ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট হল একটি ঘূর্ণায়মান শ্যাফ্ট যা পিস্টনের পারস্পরিক গতিকে ঘূর্ণন গতিতে রূপান্তরিত করে। এটি ডিজেল ইঞ্জিনের ফ্লাইহুইলের সাথে সংযুক্ত, যা শক্তি সঞ্চয় করে এবং ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে সে বিষয়টিকে মসৃণ করতে সাহায্য করে।
৬. ফুয়েল ইনজেক্টর

ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম ইঞ্জিনের জ্বালানি চেম্বারে জ্বালানি সরবরাহের জন্য কাজ করে। ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম একটি জ্বালানী পাম্প, জ্বালানী ইনজেক্টর এবং একটি জ্বালানী ফিল্টার নিয়ে গঠিত। সঠিক পরমানুকরণ এবং দহন নিশ্চিত করার জন্য জ্বালানীকে উচ্চ চাপে দহন অংশে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
৭. টার্বোচার্জা

টার্বোচার্জার এমন একটি যন্ত্র যা ইঞ্জিনে প্রবেশ করা বাতাসকে সংকুচিত করে এবং এর ঘনত্ব বাড়ায়। এর ফলে আরও দক্ষ দহন এবং উচ্চ শক্তির আউটপুট হয়। ডিজেল ইঞ্জিনের টার্বো চার্জার একটি টারবাইন এবং একটি কম্প্রেসার নিয়ে গঠিত। এটি যথাক্রমে নিষ্কাশন গ্যাস এবং বায়ু গ্রহণ দ্বারা চালিত হয়।
৮. নিষ্কাশন সিস্টেম

নিষ্কাশন সিস্টেম ইঞ্জিন দ্বারা উৎপাদিত নিষ্কাশন গ্যাস বাইরে বের করে দিতে কাজ করে। এটি একটি নিষ্কাশন ম্যানিফোল্ড, একটি ক্যাটালিষ্ট এবং একটি মাফলার নিয়ে গঠিত। ক্যাটালিস্ট টি নিষ্কাশন গ্যাসের ক্ষতিকারক দূষণকে পরিশোধন করে কম ক্ষতিকারক পদার্থে রূপান্তরিত করে এবং মাফলার ইঞ্জিনের শব্দের মাত্রা কমায়।
৯. লুব্রিকেশন সিস্টেম

লুব্রিকেশন সিস্টেম ইঞ্জিনের চলমান অংশগুলিকে তৈলাক্তকরণ এবং ঘর্ষণ কমানোর জন্য কাজ করে। এটি একটি তেল পাম্প, তেল ফিল্টার এবং তেল প্যাসেজ নিয়ে গঠিত। এটি ইঞ্জিনের বিভিন্ন উপাদানে তেল সরবরাহ করে প্রক্রিয়া চলমান রাখতে সাহায্য করে।
ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে তা এর পার্টস গুলোর ব্যবহার থেকেও বোঝা যায়। তারপরেও এবার মূল আলোচনায় আশা যাক, ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে?
একটি ডিজেল ইঞ্জিন শক্তি উৎপন্ন করতে দহনের নীতি ব্যবহার করে। ডিজেল ইঞ্জিনের সিলিন্ডার ব্লক, সিলিন্ডার হেড, পিস্টন, কানেক্টিং রড, ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট, ক্যামশ্যাফ্ট, ভালভ, ফুয়েল ইনজেক্টর এবং এয়ার ইনটেক এবং এক্সজস্ট সিস্টেম সহ সকল অংশ পরস্পর সংযুক্ত থেকে ইঞ্জিন পরিচালিত করতে কাজ করে।

- প্রথমে এয়ার ইনটেক সিস্টেমের মাধ্যমে ইঞ্জিনে এবং সিলিন্ডারে বাতাস টানা হয়। ইঞ্জিনের পিস্টন গুলো তখন সিলিন্ডারের মধ্যে সেই বাতাসকে সংকুচিত করে এবং বাতাসের তাপমাত্রা ও চাপ বাড়ায়।
- একই সাথে সেই সময় ডিজেল ইঞ্জিন জ্বালানী ইনজেক্টর ব্যবহার করে একটি সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো অবস্থার সৃষ্টি করে সিলিন্ডারে ইনজেকশন করে। তা সিলিন্ডারের মধ্যে তাপ ও চাপ বৃদ্ধি করে জ্বালানি জ্বালায়।
- সিলিন্ডারের মধ্যে এই অবস্থাকে একটি নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণও বলা হয়। এই বিস্ফোরণ পিস্টনকে নিচে ঠেলে দেয় এবং ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্টকে ঘুরিয়ে দেয়। ফলে একটি গাড়িতে শক্তির সঞ্চার হয়।
- ডিজেল ইঞ্জিনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ফুয়েল ইঞ্জেক্টর। প্রয়োজনের সময় সিলিন্ডারে সঠিক পরিমাণে জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য এটি ক্রমান্বয়ে কাজ করে যায়।
- সিলিন্ডারে ইনজেকশন করা জ্বালানির পরিমাণ ইঞ্জিনিয়ার মেইনটেনেন্স কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর জন্য ইঞ্জিন জুড়ে বিভিন্ন ধরনের সেন্সর থাকে যা ফুয়েল এর প্রয়োজনীয়তা নিরীক্ষণ করে।
- ফুয়েল ইঞ্জিন পরিচালনা করতে বায়ু গ্রহণ এবং নিষ্কাশন সিস্টেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত এয়ার ইনটেক সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার সিলিন্ডারে পরিষ্কার ও ফিল্টার করা বাতাস সরবরাহ করে। অন্যদিকে, নিষ্কাশন সিস্টেম ইঞ্জিন থেকে দহন হওয়া বায়ু ও গ্যাস গুলো সরিয়ে দেয়।
- ডিজেল ইঞ্জিনের নিষ্কাশন গ্যাস গুলো পরিবেশে ছাড়ার পূর্বে ইঞ্জিনের ভেতরে থাকা টার্বোচার্জার ও অন্যান্য রূপান্তরকারী পার্টস দিয়ে পরিচালিত হয়ে পাইপ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
একটি ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকেই সম্পূর্ণ জানা যায়। নিচে একটা ভিডিও দিয়ে দিলাম।
ডিজেল ইঞ্জিনের সুবিধা
অন্যান্য ইঞ্জিন গুলোর তুলনায় ডিজেল ইঞ্জিনে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন-
- ডিজেল ইঞ্জিল গুলোর জ্বালানি দক্ষতা অনেকটাই বেশি হয়।
- ডিজেল ইঞ্জিনের কম্প্রেশন অনুপাত বেশি এবং অধিক তাপশক্তি উৎপাদন করতে পারে।
- পরিচালনার ক্ষেত্রেও গাড়িতে ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার অনেকটাই সহজ।
- দূরপাল্লার বাহনগুলো যেমন- বাস, ট্রাক এর জন্য এটি খুবই উপযোগী এবং দ্রুত কাজ করে।
- ডিজেল ইঞ্জিন সাধারণ ইঞ্জিনের তুলনায় অনেক বেশী চাপ সহ্য করতে পারে।
- এর স্থায়িত্ব দীর্ঘদিন টেকসই হয় এবং তেমন সার্ভিসিং এর প্রয়োজন হয় না।
- ডিজেল ইঞ্জিন পরিবেশ দূষণ রোধ করে। এর নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো এবং কম পরিবেশ দূষক নির্গত করে।
- বিভিন্ন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলে ডিজিটাল জ্বালানি গ্যাসোলিনের তুলনায় কম দাহ্য পদার্থ। ফলে আগুনের দূর্ঘটনায় ডিজেল ইঞ্জিন নিরাপদ।
ডিজেল ইঞ্জিন ও পেট্রোল ইঞ্জিনের পার্থক্য

ডিজেল ইঞ্জিন এবং পেট্রোল ইঞ্জিন হলো দহন পদ্ধতিতে পরিচালিত দুটি ইঞ্জিন। যদিও উভয় ধরনের ইঞ্জিন জ্বালানিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে, তবুও তাদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে ডিজেল ইঞ্জিন এবং পেট্রোল ইঞ্জিনের মধ্যে কিছু মূল পার্থক্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
ধরণ | ডিজেল ইঞ্জিন | পেট্রোল ইঞ্জিন |
---|---|---|
জ্বালানি | ডিজেল ইঞ্জিন এবং পেট্রোল ইঞ্জিন গুলোর মধ্যে প্রাথমিক পার্থক্য হলো তারা যে ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে। ডিজেল ইঞ্জিনগুলো ডিজেল জ্বালানী ব্যবহার করে, যা পেট্রোলের চেয়ে ভারী জ্বালানী। | অন্যদিকে, পেট্রোল ইঞ্জিন গুলো পেট্রোল ব্যবহার করে, যা একটি হালকা জ্বালানী। |
কম্প্রেশনের অনুপাত | ডিজেল ইঞ্জিনের কম্প্রেশন অনুপাত পেট্রোল ইঞ্জিনের তুলনায় বেশি। এর মানে হলো যে ডিজেল ইঞ্জিনে বায়ু-জ্বালানির মিশ্রণটির সংকোচন রেশিও বেশি হওয়ায় পেট্রোল ইঞ্জিন থেকে বেশি দক্ষভাবে চলে। | অন্যদিকে, পেট্রোল ইঞ্জিনগুলোর সংকোচন অনুপাত কম, ফলে জ্বালানি ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য স্পার্ক প্লাগ প্রয়োজন হয়। |
ইগনিশন | ডিজেল ইঞ্জিন গুলোতে কম্প্রেশন ইগনিশন ব্যবহার করে সংকুচিত বায়ু দ্বারা উৎপন্ন উচ্চ তাপমাত্রার মাধ্যমে জ্বালানি দহন হয়। | অন্যদিকে, পেট্রোল ইঞ্জিনগুলো স্পার্ক ইগনিশন ব্যবহার করে। এতে করে স্পার্ক তৈরি হয়ে জ্বালানি দহন হয়। |
টর্ক এবং পাওয়ার | ডিজেল ইঞ্জিনগুলো সাধারণত পেট্রোল ইঞ্জিনের তুলনায় বেশি টর্ক তৈরি করে। তাই ডিজেল ইঞ্জিন গুলো ভারী বস্তু পরিবহন করতে বেশি উপযুক্ত। | পেট্রোল ইঞ্জিন গুলো ডিজেল ইঞ্জিনের চেয়ে বেশি গতিশক্তি দেয়। ফলে উচ্চগতির গাড়ি পরিচালনায় যেমন রেসিংয়ের জন্য পেট্রোল ইঞ্জিন বেশি উপযুক্ত। |
সাশ্রয় | ডিজেল ইঞ্জিন গুলো পেট্রোল ইঞ্জিনের তুলনায় বেশি জ্বালানী সাশ্রয়ী হয়। ডিজেল ইঞ্জিনে পেট্রোলের তুলনায় ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এ ধরনের ইঞ্জিনের কম্প্রেশন অনুপাত বেশি হয় এবং স্বল্প জ্বালানিতেই ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বেশি থাকে। | অন্যদিকে, পেট্রোল ইঞ্জিন গুলো ভালো ড্রাইভিং এক্সপেরিয়েন্স দিলেও এতে বেশি পরিমাণ জ্বালানীর প্রয়োজন হয়। |
পরিশেষে
উপরোক্ত আলোচনায় জানতে পারলাম, ডিজেল ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে ও ডিজেল ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে বিস্তারিত। এর পরেও যদি আপনাদের মনে কোন প্রশ্ন আসে তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে? এই লেখাটি এর মধ্যে পড়ে নিতে পারেন।