দৈনন্দিন জীবনে মেগা, গিগা, ন্যনো এই শব্দ গুলো শুনে থাকি। তবে, মেগাবাইট, গিগাবাইট শব্দগুলো ডাটার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এখন কথা হলো, ন্যানো টেকনোলজি কি?
“ন্যানো টেকনোলজি (Nanotechnology) ” এক ধরনের টেকনোলজির নাম। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে মানুষের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহের কথা চিন্তা করে আবিষ্কার করা হচ্ছে নতুন নতুন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। যা মানুষ কাজে লাগাচ্ছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্নভবে।
ন্যানো টেকনোলজি সেরকমই একটি নাম। চিকিৎসা ক্ষেত্রে, শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতে আনতে পারে। এই লেখায় সহজভাবে ন্যানো টেকনোলজি কি? ও এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ন্যানো টেকনোলজি কি?
নাম শুনেই নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন যে, এটি প্রযুক্তি সম্পর্কিত। পরমাণু ও অণু এই নাম দুইটি আমরা জানি। তো, পারমাণবিক ও আণবিক স্কেলে অতি ক্ষুদ্র ডিভাইস তৈরি করার জন্য ধাতব বস্তুকে সুনিপুনভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞানকে বলা হয় ন্যানো টেকনোলজি।
১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগকে বলা হয় ন্যানো মিটার। আবার একটু লক্ষ করি- ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ মাত্র! তাহলে একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পাটবেন কত ছোট এই সংখ্যা!
ন্যানো শব্দের অর্থ?

ন্যানো মেট্রিক পদ্ধতির একটি মাপার বা পরিমাপ করার একক। ন্যানো শব্দটি এসেছে গ্রীক থেকে। গ্রীক এ এর মানে ‘nanos’। সেখান থেকেই এর সূচনা। ন্যানোর অভিধানিক অর্থ হল dwarft। আর এই ন্যানোমিটাটর স্কেলের সাথে পৃথিবীর যত প্রযুক্তি সম্পর্কিত সকল কিছুই ন্যানো টেকনোলজির অন্তর্ভুক্ত। ন্যানো টেকনোলজির আরেক নাম ন্যানো প্রযুক্তি। একে সংক্ষেপে ন্যানোটেক- ও বলা যায়।
ন্যানো টেকনোলজি জনক কে?
ইতিহাসে আমেরিকান এক বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি ছিলেন একজন পদার্থবিদ। ১৯৫৯ সালে ২৯ শে ডিসেম্বর তারা অনেকে মিলে একটি আলোচনায় বসেছিলেন। সেই আলোচনাতেই একসময় তিনি এই ন্যানো টেকনোলজির ধারনা সকলের সামনে নিয়ে আসেন, সেখান থেকেই শুরু। এই ন্যানো টেকনোলজির নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ।
যেসকল ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়
আক্ষরিক অর্থে ন্যানো অর্থ সূক্ষ্ণ, ছোট হলেও এটি অনেক ধরনের বড় বড় কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম। বর্তমানে পারসাণবিক, আণবিক পর্যায়ে বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ব্যাপক! শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র গুলোতে এর ব্যবহার দেখেই বোঝা যায় এটি বর্তমান বিশ্বে কতটা প্রয়োজনীয় ছিল।
- খাদ্য সংস্থা
- পানীয় সংস্থা
- ডিফেন্স
- কৃষিক্ষেত্র
- চিকিৎসা ক্ষেত্র
- বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র
- পরিবেশ বিজ্ঞান
- ইলেকট্রনিকস
- মেডিক্যাল বিজ্ঞান
- ফার্মাস
- বিভিন্ন গবেষণা
- উন্নয়ন প্রকল্প
- বায়োটেকনিক্যাল ক্ষেত্রে
- শিক্ষা ব্যবস্থায়
- পন্য উন্নয়নে
তো বুঝতেই পারছেন যে সকল দিকেই ন্যানোটেক এর ব্যবহার আছে।
ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার
- ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে এমন এক ধরনের বাল্ব তৈরি সম্ভব যা মানবজীবনে বিপুল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এই বাল্বগুলো অতি সূক্ষ্ণভাবে তৈরি করা হচ্ছে। এই বাল্বগুলো ব্যবহার করার ফলে মানুষের বিদ্যুৎ খরচ কমে যাবে অনেকাংশে। তবে, এ কারণে আলের কোনো ধরনের তারতম্য হবে না। বরং আলো পাওয়া যাবে বর্তমান সাধারন বাল্বগুলোর থেকে অনেক বেশি।
- ন্যানো প্রযুক্তি এমন এক ধরনের সার তৈরি করা সম্ভব, যে সার জমিতে প্রয়োগ করার ফলে ফসল উৎপাদন করা যাবে প্রচুর বেশি।
- বর্তমান পৃথিবীতে বায়ু দূষণের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাড়ির কালো ধোঁয়া, শিল্প কারখানার ধোঁয়া সব মিলিয়ে বর্তমানে বায়ুদূষণ পৌঁছে গেছে এক উচ্চমাত্রায়! ন্যানো প্রযুক্তির সাহায্যে চাইলেই বায়ু দূষণ রোধ করা যায় কিছুটা। এই বায়ু দূষণের হার কমিয়ে আনতে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন কিভাবে দূষন কমিয়ে আনা যায়। তাই বর্তমানে ন্যানোটেক সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।
- আমাদের দেশে বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ আধুনিক সৌরশক্তি ব্যবহার করেন। মার্কেটে বিভিন্ন ধরনের সৌরচালিত ব্যাটারি কিনতে পাওয়া যায়। এগুলো চার্জ করার জন্য কারেন্টের প্রয়োজন হয় না। বরং সূর্যের আলোতে রেখে দিলেই সেগুলো অটোমেটিক চার্জড হয়ে যায়। এক্ষেত্রে এগুলোর দাম খুব বেশি পড়ে না। সবার হাতের নাগালের দামের মধ্যেই ( স্বল্প মূল্যে) ব্যাটারি গুলো সহজেই মার্কেটে বা বিভিন্ন সুপারশপে কিনতে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির কল্যাণেই এটি আবিষ্কৃত। তাই বলা যায় মানুষের জীবনে সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তির বড় একটি ভূমিকা রয়েছে।
- কম্পিউটারের বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেও ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়
- কম্পিউটারের জরুরি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে হার্ডওয়ার। মূলত কম্পিউটারে ভিতরে যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে অসংখ্য ন্যানো মিটার স্কেলের সাহায্যে তৈরি সার্কিট। অর্থাৎ কম্পিউটারের ক্ষেত্রে- ও ন্যানোটেকেট ভূমিকা অপরিসীম। ইন্টেল প্রসেসরে সিলিকনের ওপর প্যাটার্ন তৈরি করা হয়। এরপর এখান থেকে সার্কিট তৈরী করা হয়। এর আকার গিয়ে দাঁড়ায় ১০০ ন্যানোমিটারে। কম্পিউটার এর হার্ডওয়্যার অনেক ধরনের তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করে থাকে। এই যে তথ্য সংরক্ষণের ব্যাপারটি, এটা ভবিষ্যতে ন্যানো- প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত হবে আরও। অর্থাৎ কম্পিউটারের হার্ডওয়ার এ তথ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়বে। এবং তখন মাত্র ৫০ ন্যানোমিটার হবে এর আকার। বুঝতেই পারছেন কতটা ছোট। তবে তা হলেও এর তথ্য ধারন ক্ষমতা মোটেও কমবে না। বরং আরো বেশি ধরনের তথ্য ধারণ করবে, যা মানব জীবনের জন্য উপকারী।
১. ন্যানো রোবট

ন্যানো রোবট হলো ছোট এক ধরনের রোবট। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে রোবটের বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার দেখেছি। তবে রোবট আকারে বড় এবং ভারী ভারী কাজ কর। এরকম টাইপই দেখেছি। তবে ন্যানো প্রযুক্তির সাহায্যে এমন এক ধরনের রোবট তৈরি করা সম্ভব, যা হবে অতি সূক্ষ্ম। এমন হতে পারে যে চোখে দেখা না- ও যেতে পারে! তবে এসব রোবট ছোট হলেও হবে অসম্ভব উপকারী।
বর্তমান যুগে মানুষের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বর্তমানে অনেক বড় বড় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় এবং এগুলোর মাধ্যমে বাহ্যিক অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে অভ্যন্তরীন অস্ত্রোপচার এর জন্য দরকার ছোট যন্ত্রপাতি। অভ্যন্তরীণ কোনো অপারেশন এর জন্য এই রোবট বিভিন্ন কাজ করবে। এই রোবট তখন মানব শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অস্ত্রপচার বা কিছু কাজ সম্পন্ন করতে পারবে।
২. প্যাকেজিং
বর্তমানে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য প্যাকেটজাত করার জন্য ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে। প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে অনেক কাজ থাকে যেগুলো করার জন্য অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রের প্রয়োজন। আর সেই কাজগুলো অনায়াসে করে দেয় ন্যানো টেকনোলজি।
৩. খেলাধুলার ক্ষেত্রে
খেলাধুলার প্রত্যেকটি উপকরম তৈরির কাজে বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে সবসময়ই। এই যেমন, টেনিস বল দিয়ে যেন অনেক্ষন খেলা যায় কিংবা গলফ খেলার সময় বাতাসেও যেন দিক পরিবর্তন না হয় এরকম নানা কাজে ব্যবহার হয় ন্যানো টেকনোলজি।
৪. জ্বালানি ও কৃষি ক্ষেত্রে
এছাড়া জ্বালানি তেলের বা জ্বালানি খাতের জন্য এই টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। ন্যানো সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক গভীরের তথ্য জানা যাচ্ছে। ভারী ধাতুর উপস্থিতি জানা যাচ্ছে। ফসলের রোগ কিংবা মাটিতে কখন কোন সার বা পানি প্রয়োজন তা জানা যাচ্ছে।
৫. ইলেকট্রনিকস ডিভাইস
আমরা যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করি তা আরও উন্নত করে ব্যবহার করার জন্য ন্যানোটেক ইউজড হচ্ছে। এতে সূক্ষ্ণ জিনিসে অনেক উপকার হবে। মানুষের সাশ্রয়ও বাড়বে।

ন্যানো টেকনোলজির সুবিধা
- ন্যানো টিউব বা ন্যানো পার্টিকেল এসব ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানোটেক। ফলে সকল বস্তু উন্নত, হালকা ও কম দামী হচ্ছে।
- এই টেকনোলজি ব্যবহার করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
- খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিং এর জন্য এর সাহায্য নেয়া হচ্ছে।
- ন্যানো ডায়োড এর মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে বিস্ময়কর পরিবর্তন হচ্ছে।
- ন্যানোটেক দিয়ে তৈরিকৃত সকল ইলেকট্রনিকস বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে।
- এর মাধ্যমে সৌরশক্তিকে নানাভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে।
- এর সাহায্যে তৈরি রোবট বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
ন্যানো টেকনোলজির অসুবিধা
- ন্যানো টেকনোলজির সবচেয়ে বড় অসুবিধা এটি মানব দেহের জন্য প্রচুর ক্ষতিকর!
- এছাড়া এর দ্বারা তৈরি ইলেকট্রনিকস ধীরে ধীরে কম দামপর দিকে গেলেও এখন এটা অনেক ব্যয়বহুল। যার ফলে পরিবর্তন হতে এখনো সময় লাগবে।
পরিশেষে
সবশেষে দেখলেন ন্যানো টেকনোলজি কি এবং ন্যানোটেক এর অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি। যার ফলে বিশ্ব এখন এর প্রতি প্রচুর গবেষনা করছে। আশা করি এই লেখায় আপনারা ন্যানো টেকনোলজি কি এ সম্পর্কে সংক্ষেপে ও সহজভাবে সবটুকু ধারনা পেয়েছেন।