বাষ্পীয় ইঞ্জিন যদিও এখন খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু, অনেকের অনুসন্ধানী মন সব সময় জানতে চায়, বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে? বাষ্পীয় ইঞ্জিন হলো এমন একটি যন্ত্র যেটি কয়লা পুড়িয়ে তাপ উৎপাদন করে।
এটি কয়লা বহন করে। তাই এটি তাপ ইঞ্জিনের একটি উদাহরণ। কয়লার আগুনের উপর একটি বিশালাকার কেটলি বসানো থাকে। আগুনের তাপে কেটলির পানি সিদ্ধ হতে থাকে এবং তা থেকে বাষ্প বের হতে থাকে। কিন্তু এই বাষ্প বাতাসে ভেসে বেড়ায় না বরং এই বাষ্প যন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধি করে।
কি অদ্ভুদ বিষয়, তাই না! আজকের আলোচনা মূলত এই অদ্ভুদ বিষয় নিয়ে তথা, বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে?
বাষ্পীয় ইঞ্জিনে কোথা থেকে শক্তি আসে?
বর্তমানে আমরা যাতায়াত বা পরিবহনের জন্য যে ধরনের যান ব্যবহার করে থাকি তার অধিকাংশেই তেল চালিত। কিছু কিছু গ্যাস চালিত। কিন্তু যান চলাচলের প্রাচীন যুগে বিষয়টা এমন ছিল না। তখন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হত কয়লা। কয়লা ছিল খুব জনপ্রিয় জ্বালানি যার দ্বার ট্রেন, জাহাজ বা প্লেন ও চলাচল করত।
কয়লা হলো একটি জৈব যৌগ। এটি কার্বনের একটি রূপ। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মাটির নিচে যে পাথর চাপা পড়ে থাকে, অতিরিক্ত চাপের কারণে এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরের তাপের কারণে তা কয়লায় পরিণত হয়ে থাকে।
এই জন্য একে বলা হয় জীবাশ্ম জ্বালানি। এক একটা কয়লার টুকরো, এক একটি শক্তি। কয়লার ভিতরে কার্বন পরমানু হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে রাসায়নিক বন্ধন সৃষ্টি করে থাকে। যখন কয়লা আগুনে পোড়ানো হয় তখন এই বন্ধন ভেঙে যায় এবং তাপশক্তি রূপে বের হয়।
বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে?
বাষ্পীয় ইঞ্জিনের প্রধান চারটি ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রাংশ রয়েছে।

- প্রথমটি হচ্ছে অগ্নিকুন্ড যেখানে কয়লা পোড়ানো হয়ে থাকে।
- একটি পানি ভর্তি বয়লার যেখানে তাপের ফলে পানি বাষ্প হতে থাকে।
- একটি সিলিন্ডার ও একটি পিস্টন। এটি অনেকটা বাই সাইকেলের পাম্পের মত কিন্তু আকারে অনেক বড়। বয়লারে উৎপন্ন বাষ্প সিলিন্ডারের পাইপের সাহায্যে উপরে উঠে আসে এবং এর ফলে পিস্টন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নড়াচড়া করে থাকে।
- পিস্টনের সাথে একটি মেশিন যুক্ত থাকে। এটি যেকোন কাজ করতে সক্ষম। একটি পানির পাম্প থেকে শুরু করে একটি ফ্যাক্টরির মেশিন অথবা একটি বিশালাকার ইঞ্জিন যে কোন কিছু চালাতে সক্ষম এই মেশিন।
এটা আসলে খুব সাধারণ বিবরণ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শত শত বা হাজার হাজার যন্ত্রাংশ রয়েছে এর ভেতরে।
বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মধ্যে থাকে একটি ফায়ারবক্স যেটায় থাকে কয়লা ভর্তি। এটা পুরোটাই একটা ধাতব বক্স যেটা কয়লার আগুন বহন করে থাকে। এই আগুন বয়লারে তাপ দেয়।
বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মধ্যে যে কেটলি থাকে সেটি চায়ের কেটলির মতো নয় কিন্তু এর কাজ অনেকটা চায়ের কেটলির মতোই। উচ্চ তাপে ও চাপে বাষ্প তৈরি করে থাকে। বয়লার হচ্ছে পানিভর্তি বিশাল ট্যাংক যার ভিতর ডজনখানেক পাতলা ধাতব টিউব থাকে। এই টিউবগুলো ফায়ারবক্স থেকে চিমনিতে গিয়ে শেষ হয় এবং আগুনের ধোঁয়া ও তাপ বহন করে নিয়ে যায়।
বয়লার থেকে উৎপন্ন হওয়া বাষ্প সিলিন্ডারের সাহায্যে চাকায় গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে থাকা পিস্টনের ডান্ডাটি সামনে পিছনে ধাক্কা দেয়। সিলিন্ডারের ভিতর থাকে একটি ছোট যান্ত্রিক গেট যেটি ইনলেট ভালব নামে পরিচিত। এর সাহায্যে বাষ্প ভিতরে প্রবেশ করে। এই পিস্টন একটার পর আরেকটা চাকার সাথে এমনভাবে সংযুক্ত থাকে যেমনভাবে আমাদের কাধ, কনুই ও বাহু একটার সাথে আরেকটা যুক্ত থাকে। এই সংযোগকে বলা হয় ক্র্যাঙ্ক এন্ড কানেকটিং রড।
যখন পিস্টন চাপ দেয় তখন এই এন্ড কানেকটিং রড যন্ত্রের চাকার সাথে ঘুরে এবং যন্ত্রে শক্তি সঞ্চালিত হয়। যখন এই পিস্টন সিলিন্ডারের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায় তখন এটি আর ধাক্কা দিতে পারে না। কিন্তু যন্ত্রের চালিকাশক্তি তখন আবার ক্র্যাঙ্ককে পেছনে পাঠায়। ধাক্কার ফলে পিস্টনটি পেছনের দিকে চালিত হয়। এই সময় ইনলেট ভালব বন্ধ থাকে।
তখন আউটলেট ভালব খুলে যায় এবং পিস্টনটি এর সাহায্যে বাষ্প সিলিন্ডারের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করায় এবং সেটা যন্ত্রের চিমনিতে গিয়ে পৌঁছে। ইঞ্জিন চলার সময় অনবরত যে ঝিকঝিক শব্দ হয় এবং এতে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা ঘটে থাকে সিলিন্ডারের মধ্যে অনবরত পিস্টনের নড়াচড়ার ফলে।
যন্ত্রের দুইপাশেই দুইটি সিলিন্ডার থাকে। দুইটি সিলিন্ডারই সমানভাবে একই ধাপ অনুসরণ করে যাতে ইঞ্জিন সবসময় সমান শক্তি পেয়ে থাকে।
- আরও পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার কিভাবে কাজ করে?
বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ধরন
বিভিন্ন বিজ্ঞানী দ্বারা বিভিন্নভাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। নিচে কিছু ধরন আলোচনা করা হলো।

১. কাজের গতির উপর ভিত্তি করে দুই প্রকার।
সিঙ্গেল একটিং বাষ্পীয় ইঞ্জিন: এই ইঞ্জিনে বাষ্প একদিক থেকে প্রবেশ করে।
ডাবল একটিং বাষ্পীয় ইঞ্জিন: এই ইঞ্জিনে বাষ্প দুইদিক থেকে প্রবেশ করে। এর শক্তি সিঙ্গেল একটিং ইঞ্জিন থেকে বেশি হয়।
২. সিলিন্ডারের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে দুই প্রকার।
আনুভূমিক বাষ্পীয় ইঞ্জিন: সিলিন্ডার যখন অক্ষের সমান্তরাল থাকে তখন সেটিকে আনুভূমিক বাষ্পীয় ইঞ্জিন বলে।
উল্লম্ব বাষ্পীয় ইঞ্জিন: সিলিন্ডার যখন অক্ষের উপর লম্বভাবে অবস্থান করে তখন সেটিকে উল্লম্ব বাষ্পীয় ইঞ্জিন বলে। এই ইঞ্জিনে আনুভূমিক ইঞ্জিনের চেয়ে জায়গা কম লাগে।
৩. ক্র্যাঙ্ক শ্যাফটের গতির উপর ভিত্তি করে তিন প্রকার।
ধীর গতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্পীয় ইঞ্জিনের গতি যদি ১০০ আর পি এম এর কম হয় তবে সেটা ধীর গতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
মধ্যম গতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্পীয় ইঞ্জিনের গতি যদি ২৫ আর পি এম ও ১০০ আর পি এম এর মধ্যে হয় তখন সেটি মধ্যম গতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
দ্রুত গতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্পীয় ইঞ্জিনের গতি যদি ২৫০ আর পি এম এর উপরে হয় তখন সেটি দ্রুত গতির বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
৪. ধোঁয়া নির্গমনের উপর ভিত্তি করে দুই প্রকার।
ঘনীভূত বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্প সিলিন্ডারের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় যখন সেটি ঘনীভূত হয়ে পানিতে পরিণত হয় তখন সেটিকে ঘনীভূত বাষ্পীয় ইঞ্জিন বলে।
ঘনীভূত ছাড়া বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্প যখন পরিবেশে বের হয়ে যায় তখন তাকে বলে ঘনীভূত ছাড়া বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
৫. সিলিন্ডারের ভিতর বাষ্পের সম্প্রসারণের উপর ভিত্তি করে দুই প্রকার
সিম্পল বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্প যখন একটি সিলিন্ডার দ্বারা সম্প্রসারিত হয় তখন একে বলে সিম্পল বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
কম্পাউন্ড বাষ্পীয় ইঞ্জিন: বাষ্প যখন দুই বা ততোধিক সিলিন্ডার দ্বার সম্প্রসারিত হয় তখন তাকে বলে কম্পাউন্ড বাষ্পীয় ইঞ্জিন। এই ধরনের ইঞ্জিন গুলো সাধারনত ঘনীভূত ইঞ্জিন হয়ে থাকে।
- আরও পড়ুন: এয়ার কন্ডিশনার কিভাবে কাজ করে?
৬. সরকারি পদ্ধতি অনুযায়ী দুই প্রকার
থ্র্রটলিং বাষ্পীয় ইঞ্জিন: যে ধরনের ইঞ্জিনের গতি থ্রটল ভালব দ্বারা পরিচালিত হয় সেগুলো থ্র্রটলিং বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
অটোমেটিক কাট অফ বাষ্পীয় ইঞ্জিন: এই ধরনের বাষ্পীয় ইঞ্জিনের গতি বাষ্পীয় চাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে।
বাষ্পীয় ইঞ্জিনের প্রচলন এখন অনেকটা কমে গেছে। আধুনিক যান চলাচলে জ্বালানির স্থান দখল করে নিয়েছে ডিজেল ও গ্যাস।
উপসংহার
এই ছিল আজকে, বাষ্পীয় ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা। আপনার মনে যদি এবার প্রশ্ন বৃদ্ধি পায় তাহলে, আমাদের টেক জ্ঞান ক্যাটেগরির লেখাগুলো পড়তে পারেন।