ঘড়ি তো ঘড়ি, এটার আবার স্মার্ট আনস্মার্ট কি জিনিস! এরকম প্রশ্ন কি আপনার মাথায় ঘুরপাক খায়? কিংবা স্মার্ট ওয়াচ কি আসলে? এটা সত্য, আমরা প্রযুক্তি বিশিষ্ট এক যুগে বাস করি। যেখানে একটি আঙুলের সোয়াইপ দিয়ে, মোবাইল ফোনের মালিকরা সেকেন্ডের মধ্যে অবিশ্বাস্য পরিমাণের তথ্য দেখতে সক্ষম হন।
তারা তাদের ইমেল চেক করতে পারে, ছবি তোলার পরপরই ছবি আপলোড করতে পারে, অনলাইনে পছন্দনীয় আইটেম কিনতে পারে এবং খুব কম সময়ে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করতে পারে।
আজকের স্মার্ট ফোনগুলি দ্রুত তথ্য প্রেরণ করে এবং গ্রহণ করে। ডেটার তাৎক্ষণিক অ্যাক্সেসযোগ্যতা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তাহলে ভাবুন, যদি একটি স্মার্ট ফোন একা এ সব করতে পারে, তাহলে আপনার স্মার্টওয়াচের প্রয়োজন হবে কেন? কেন, আপনি অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে স্মার্ট ওয়াচ কিনবেন? এই স্মার্ট ওয়াচ কি আসলে? এর সুবিধা কি এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা আজকের লেখায় জানবো।
স্মার্ট ওয়াচ কি?
স্মার্ট ওয়াচ, প্রযুক্তির একটি নতুন উদ্ভাবন। এটি একটি কম্পিউটারাইজড হাতঘড়ি যাকে আমরা আগের যুগের পিডিএ ডিভাইসের সাথে তুলনা করতে পারি। এটির প্রতিটি মডেলের সাথে বিভিন্ন ফাংশন রয়েছে, যা ব্যবহারকারীকে নতুন এবং আর্কষণীয় কিছু সার্ভিস প্রদান করে। এক কথায়, স্মার্টওয়াচ হল ঘড়ির আকারে একটি পরিধানযোগ্য কম্পিউটার, আধুনিক স্মার্টওয়াচগুলি ব্যহারে সহজ করার জন্য টাচস্ক্রিন ইন্টারফেস সরবরাহ করে।
প্রথম ডিজিটাল ঘড়ি, ১৯৭২ সালে, হ্যামিল্টন ওয়াচ কোম্পানি নির্মাণ করে যার নাম পালসার ছিল। “পালসার” একটি ব্র্যান্ড নাম হয়ে ওঠে যা পরে ১৯৭৮ সালে সেকো ক্রয় করে নেয়।
২০১০ এর দশকে স্মার্টওয়াচ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এগুলি প্রায়শই ফিটনেস ট্র্যাকার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এই ঘড়িগুলোকে মূলত স্পোর্টস ওয়াচ বলে। ২০১৯ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে গ্লোবাল স্মার্টওয়াচ বিক্রির পরিমাণ গণনা করা হয় ১৪ মিলিয়ন। সে হিসাবে ২০১৯ সালের মার্কেট কিং ছিল অ্যাপল, এরপর স্যামসাং, ইমু, ফিটবিট, অ্যামাজফিট, হুয়াওয়ে, ফসিল এবং গার্মিন।
সর্বশেষ স্মার্ট ওয়াচ উদ্ভাবন করা হয়েছে ২০২০ সালে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন নাইটওয়্যার নামে বাজারে এনেছে। স্মার্টওয়াচটির লক্ষ্য পিটিএসডি সম্পর্কিত দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ঘুমকে উন্নত করা। এটি হৃদস্পন্দন এবং শরীরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে দুঃস্বপ্ন সনাক্ত করে এবং তথ্য প্রদান করে।
এভারেজ স্মার্টওয়াচ মৌলিক কাজগুলি সম্পাদন করে থাকে। আধুনিক স্মার্টওয়াচ অবশ্য মোবাইল অ্যাপগুলি চালাতে পারে। গান বাজানোর জন্য বা কল পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে আপনার মোবাইল ফোনের উপর নির্ভর না করে, আপনি আপনার কব্জিতে থাকা ঘড়িটি দিয়ে করে ফেলতে পারেন।

স্মার্ট ওয়াচ মুটামুটি ৬ প্রকারের যথা:
- সাধারণ স্মার্টওয়াচ: সাধারণ কাজের জন্য সাধারণত এই ধরণের স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করা হয়। যেমন, কল করা, মেসেজ দেখা, স্যোশাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন দেখা ইত্যাদি।
- স্পোর্টস ওয়াচ: শরীরের হার্টবিট, ব্লাড প্রেসার, অক্সিজেন লেভেল, ঘুম ট্রেক করা, হাঁটা, সাইকেলিং ট্রেক করার মত কাজগুলো করে দেয় এই স্পোর্টস ওয়াচ। এছাড়া, স্মার্টফোনের নোটিফিকেশনও দেখা যায় এর মাধ্যমে।
- স্মার্ট ব্যান্ড: Mi Band 6, Honor Band 5 এই সবগুলো স্মার্ট ব্যান্ডের উদাহরণ। দেখতে ব্রেস লেট তথা ব্যান্ডের মত। এইগুলোতে স্পোর্টস ওয়াচের অধিকাংশ ফিচারই বিদ্যমান।
- জিপিএস স্মার্ট ওয়াচ:যারা ভ্রমন করতে ভালোবাসেন তাদের জন্য মূলত এই ঘড়ি। এটাতে আপনার জিপিএস লোকেশন ট্রাক করা যায়। তবে, বাদবাকী অন্য সব ফিচার এর মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
- হাইব্রিড স্মার্টওয়াচ: একের ভিতর সব আরকি। উপরে যে প্রকারগুলো বললাম সেই প্রকারের সবগুলো সুবিধা আপনি এই স্মার্টওয়াচে পাবেন।
- লাক্সারি স্মার্ট ওয়াচ: আপনার যদি অনেক টাকা থাকে, খরচ করার জায়গা পাচ্ছেন না। শো অফ না করলে পেটের ভাত হজম হয় না, তাহলে এই ঘড়িগুলো আপনার জন্য। স্বর্ণ কিংবা ডাইমন্ড দিয়ে বানানো হয় এই ধরণের ঘড়ি।
স্মার্ট ওয়াচ ব্যবহারের সুবিধা
স্মার্টওয়াচ একটি স্ট্যান্ডার্ড ঘড়ির তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা বয়ে আনে। স্মার্টওয়াচ স্মার্টফোনের মত একই সুবিধা সরবরাহ করে। স্মার্ট ওয়াচে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিক সময়, গতি এবং অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়।
কিছু লোক যুক্তি দেখাবে যে স্মার্টফোন এবং স্মার্ট ঘড়ি দুইটাই একসাথে থাকার প্রয়োজন নেই। চিন্তা করবেন না, কারণ স্মার্ট ওয়াচ যে শুধু সুবিধাজনক তা ই নয়, আজকের বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। নিচে থাকা স্মার্ট ওয়াচ এর সুবিধাগুলো পড়লেই আপনার সব ভুল ভেঙ্গে যাবে।
স্মার্টওয়াচ এর সুবিধা গুলো আলোচনা করা হলঃ
- আমাদের হার্টবিট কত, আমাদের ব্লাড প্রেসার কত, আমরা দিনে কতটুকু হাটলাম কিংবা দৌড়ালাম এ জাতীয় তথ্য দেখা যায়। ফলে, যারা স্বাস্থ সচেতন তাদের জন্য এটা অপরিহার্য অংশ।
- ঘুমানোর সময় যদি এটা আপনি পরেন তাহলে, দেখতে পারবেন আপনি কতক্ষন ভাল ঘুমিয়েছেন, কতক্ষন স্বপ্ন দেখেছেন এমনকি কতক্ষন নাক ডেকেছেন সেটাও দেখতে পারবেন।
- ফিজিক্যাল এক্টিভিটি ট্র্যাকার হিসাবে কাজ করে এটি। এছাড়া, জিপিএস ট্র্যাকার হিসাবেও কাজ করে।
- যারা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন তাদেরকে এই ঘড়ি হাতে ভাইব্রেট করে জানিয়ে দিবে, আপানার এখন উঠে দাড়াতে হবে কিংবা পানি পান করতে হবে ইত্যাদি।
- এছাড়া, বাসের মধ্যে কিংবা কোন ভীড়ের মধ্যে আছেন, এমন সময় ফোন আসলো তখন ফোন বের না করেই স্মার্টওয়াচের মাধ্যমে কাজ সেরে নিতে পারেন।
- মেসেজ, কল এমনকি স্যোশাল মিডিয়ার সব নোটিফিকেশন আপনি আপনার হাতে থাকা ঘড়ির মাধ্যমে দেখতে পারবেন।
- এছাড়া, ঘড়ি এবং স্মার্টফোনের সকল সুবিধাই পাবেন।
যাইহোক নিচে আরও কিছু স্মার্ট ওয়াচ এর সুবিধা উল্লেখ করলাম।
১. সাশ্রয়ী মূল্য: প্রযুক্তির হিসেবে, স্মার্টওয়াচ বরং সাশ্রয়ী মূল্যের। এটা সত্য যত বেশি সংখ্যক কোম্পানি স্মার্টওয়াচ বানানো শুরু করবে তত এর ফিচার, কার্যকারিতা উন্নত হবে এবং দাম উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
২. কার্যকারিতা: কিছু স্মার্টওয়াচ মডেলে বিল্ট-ইন ফ্ল্যাশ ড্রাইভ রয়েছে, অন্যদের ভয়েস এবং জেশ্চার নিয়ন্ত্রণ, ক্লাউড ডেটা এবং বিল্ট-ইন ফিজিক্যাল এক্টিভিটি ট্র্যাকার রয়েছে। অনেক স্মার্টওয়াচ আপনাকে আপনার কব্জি থেকে টেক্সট এবং টুইট করার সুবিধা দেয়।
কল্পনা করুন যে আপনি জিমে ট্রেডমিলে আছেন, কে আপনাকে কল করছে বা টেক্সট করছে তা দেখার জন্য আপনাকে আর পকেটে করে ফোনটি নিয়ে ঘুরতে হবে না কিংবা বের করতে হবে না। আপনার স্মার্টওয়াচটি একবার দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন কে ফোন দিয়েছে। চাইলে, ফোনটি রিসিভ কিংবা কেটে দিতে পারবেন।
৩. প্রডাক্টিভিটি: আপনি মিটিংয়ে কিংবা ফোন থেকে দূরে। তো আপনার ফোনে মেসেজ বা ইমেল আসলো! এখন কি করবেন! জ্বি, এই কি করার সমাধান দিবে স্মার্টওয়াচ। কারণ, ঘড়ির দিকে তাকালেই বুঝবেন কে কল দিয়েছে বা কি মেসেজ দিয়েছে।
৪. সময় দেখা: একটি স্মার্ট ঘড়ির সবচেয়ে মৌলিক ফাংশন হল সময় দেখা। একটি স্মার্ট ঘড়িতে সেই সময়ের জন্য একটি ডিসপ্লে রয়েছে যা একটি স্ট্যান্ডার্ড ঘড়ির চেয়ে দেখা সহজ। অন্ধকারে বসেও সময় দেখতে পারবেন। এছাড়া, অ্যালার্ম সেট করা, স্টপওয়াচ, টাইমারের মত সব ফাংশনই পাবেন স্মার্টওয়াচে।
৫. ইন্টারনেট অ্যাক্সেস: একটি স্মার্টওয়াচ সর্বদা ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করে। এগুলি সর্বদা আপনার ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকবে। আপনি চাইলে যেকোন সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন।
৬. কথা বলার সুবিধা: স্মার্ট ওয়াচ আপনাকে স্মার্ট ফোনের মতো, অন্যান্যদের সাথে কথা বলার সুযোগ দিবে। স্মার্ট ওয়াচ দ্রুত অ্যাক্সেসের কারণে আরও বেশি সুবিধাজনক।
৭. গান শোনা: স্মার্ট ওয়াচ একটি স্ট্যান্ডার্ড ফোনের চেয়ে বেশি সুন্দরভাবে গান বাজায়। অন্য গানে স্যুইচ করতে আপনাকে আপনার পকেট থেকে ফোন বের করতে হবে না, জাস্ট ঘড়িতে একটা টাচ করলেই জ্ঞান পরিবর্তন হয়ে যাবে। আপনি আপনার স্মার্টওয়াচের মাধ্যমে ভলিউমও কমাতে-বাড়াতে পারবেন।
৮. নোটিফিকেশন দেখা: স্মার্টওয়াচের মাধমে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর কিংবা অনান্য অ্যাপের নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন খুব সহজেই।
৯. জিপিএস ট্র্যাকিং: স্মার্ট ওয়াচ দ্রুত জিপিএস সংকেত পায়, যা আপনাকে বর্তমান অবস্থানটি দ্রুত খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
উপসংহার
এই ছিল আজকে স্মার্ট ওয়াচ কি ও এর সুবিধা নিয়ে কিছু আলোচনা। আপনি বুঝতেই পারছেন, বিভিন্ন কারণ আছে কেন একজন ব্যক্তি তাদের স্মার্ট ফোন সঙ্গে তাদের স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করতে চায়।
নিউ রেলিকের গবেষণায় আবিষ্কার করা হয়েছে যে গড় স্মার্টফোন ব্যবহারকারী দিনে ১৫০ বার বা প্রতি ৬.৫ মিনিটে একবার পর্যন্ত তাদের ডিভাইসটি দেখে নোটিফিকেশন এবং টাইম দেখার জন্য। সুতরাং, সময় বাঁচাতেও স্মার্টওয়াচের গুরুত্ব রয়েছে। তবে, মোবাইল নিয়ে যদি আপনার কৌতুহল থাকে তাহলে, মোবাইল ফোন কিভাবে কাজ করে? লেখাটি পড়তে পারেন।