বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ, মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে যাচ্ছে। আসলে, আসক্তি কি ও এর ভয়াবহতা যারা জানে, তারাই মুক্তি চাচ্ছে। আপনিকি নিজেকে প্রায় সময় ক্রমাগত মেসেজ করা, ফেসবুক বা ইন্টারনেট স্ক্রল, ইমেইল পাঠানো, মোবাইল এপ্লিকেশন ব্যবহার ও গেইম খেলতে দেখেন?
এতো লম্বা সময় ধরে মোবাইল নিয়ে বসে থাকা আপনার অনেক ধরনের সমস্যার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির ফলে পরিবারের মানুষের থেকেও দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। আপনার চোখের ক্ষতি, শরীরের ক্ষতি, ডিপ্রেশন, হঠাৎ রেগে যাওয়ার মত সমস্যা এই মোবাইল আসক্তির কারণে হয়ে থাকে।
ফেসবুক আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আগের লেখা পড়ে অনেকেই, মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় জানতে চেয়েছেন। তাদের জন্য আজকের এই লেখা।
লেখার সূচিপত্র
আসক্তি কি?
এমন কোনও কাজ যা মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতি বা নিজস্ব ক্ষতির সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্যেও সে কাজের প্রতি অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা পোষণ করা এবং আকাঙ্ক্ষার পুনরাবৃত্তিকে আসক্তি বলা হয়।
মানুষ সাধারণত আসক্তির ফাঁদে পড়ে নিম্মোক্ত কারণে,
- অতিরিক্ত কৌতূহল।
- কুফল সম্পর্কে জেনেও অবজ্ঞার ছলে নেওয়া।
- মানসিক চাপ।
- নেতিবাচক বন্ধুর সাথে সম্পর্ক।
কোন লক্ষণগুলো দেখলে বুঝবেন আপনি বা আপনার কাছের কেউ আসক্তিতে ভুগছেন?
- হঠ্যাৎ করে আচরণের পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
- পড়াশোনার প্রতি অনিচ্ছা।
- স্মৃতিলোপ পেলে।
- পরিবারের সবার সাথে সম্পর্কের অবনতি হলে।
- দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়া।
- হুট করেই অপুষ্টি-জনিত কারণে শরীর শুকিয়ে গেলে।
- রাত জেগে থাকলে।
- সবসময় ছটফটানি, অস্থিরতা এবং রাগান্বিত থাকলে।
- একা একা থাকার প্রবণতা বেড়ে গেলে।
- আক্রমণাত্মক ও বেপরোয়া চলাফেরা করলে।
- রাতে ঘুম না আসা।
মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে আজকে থেকেই এই উপায়গুলো মেনে চলা শুরু করুন।
১. মোবাইল ডায়েট করুন
শুনতে অবাক লাগছে? ভাবছেন এটা আবার কেমন ডায়েট? মোবাইল ডায়েট বলতে বুঝানো হচ্ছে আমরা যেমন খাবার ডায়েটে নিজেদের খাবার ধরন, পরিমাপ, সময় ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করি ঠিক তেমনই আপনার মোবাইল ব্যবহারকে পর্যবেক্ষণ করা।
একটি সার্ভেতে দেখা গিয়েছে ১৩-১৯ বছরের বয়সের মানুষরা ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত মোবাইলে ব্যয় করে। প্রতি ঘণ্টায় কতবার আপনি মোবাইল চেক করছেন লক্ষ্য করুন, এতে আপনার নিজের প্রতি সচেতনতা বাড়বে।
আপনি যদি নিজের সমস্যা সম্পর্কে অবগত হয়ে সচেতন হোন তবে আপনি নিজের সমস্যার সমাধান বেড় করতে সক্রিয় হয়ে উঠবেন। প্রয়োজন হলে একটি সময় ট্র্যাক আপ্লিকেশন ব্যবহার করতে পারেন। আপনি সেটির তথ্য ব্যবহার করে লক্ষ্য ঠিক করে নিজের জন্য নির্দিষ্ট রুটিন বানাতে পারেন। ফোনকে ফোকাস মোডে রাখার কিছু অ্যাপ:
২. দিনের নির্দিষ্ট সময়ে মোবাইল ব্যবহার করুন
অবশ্যই সময়টা সীমিত সময়র জন্য হতে হবে যেমন: আপনি বিকাল ৫-৬ টা পর্যন্ত মোবাইল চালাতে পারেন। এছাড়া আপনি কিছু নির্দিষ্ট সময় যেমন: স্কুলে থাকা সময়, কাজের সময়, পড়র সময়গুলোতে মোবাইল ব্যবহার হতে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন।
আপনি যখন মোবাইল চালানোর সর্বশেষ সময়ে পৌঁছে যাবেন, সে সময়টায় নিজেকে অবগত করার জন্য এলার্ম দিয়ে রাখতে পারেন। নিজের ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য এবং আপনি কোন লক্ষ্যটি পূরণ করেছেন, কোনটি করতে পারেননি লিখে রাখুন। এতে আপনার লক্ষ্যের উপর মনোনিবেশ বাড়বে।
৩. নিজেকে পুরস্কৃত করুন
মোবাইলে কম সময় কাটাতে সফল হওয়ার জন্য নিজেকে নিজেই পুরস্কৃত করুন। এমন কিছু নিজেকে দিতে পারেন যা আপনার পছন্দ বা যেটা করতে আপনি ভালোবাসেন যেমন: আপনার পছন্দের খাবার, নতুন কিছু কিনা ইত্যাদি।
এই ধরনের কাজকে ইতিবাচক স্ব-শক্তিবৃদ্ধি বলা হয়।নিজেকে নিজে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে যে কোনও মানুষের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মূলত, এর ফলে আপনার ব্রেন ডোপামিন রিলিজ করবে। যা আপনাকে আনন্দ দিবে।
৪. ধাপে ধাপে চেষ্টা করুন
একদিনে একেবারের জন্য মোবাইল চালানো বাদ না করে ধীরে ধীরে ব্যবহারের সময় কমিয়ে আনুন। শুধুমাত্র নিজের অতি-প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ব্যবহার থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন।
ডায়েরিতে নোট করুন প্রতিদিন কত সময় করে মোবাইল ব্যবহার আপনি কমাতে পারছেন। লক্ষ্য রাখুন গতকালের তুলনায় আজকের রেকর্ডে আপনার মোবাইল ব্যবহারের সময় যেনো আরও কম হয়।
৫. মোবাইল দূরে রাখুন
চেষ্টা করুন কর্মক্ষেত্রে, অধ্যয়নরত অবস্থায় বা যেনো কাজের সময় মোবাইল দূরে রাখুন, এমন জায়গায় যেখানে সহজে আপনার চোখ না যায় যাতে মোবাইল আপনাকে বিভ্রান্ত / অন্যমনস্ক করে না তুলে।

৬. ছুটি নিন
একদিনের জন্য মোবাইলের কাছ হতে ছুটি নিন। সে একটি দিনে সারাদিন কোনরকম কাজে মোবাইল ধরবেন না। পুরোটা-দিন শুধুমাত্র নিজের সাথে বা পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেন, পছন্দের কাজগুলো করতে পারেন, কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন ইত্যাদি।
৭. ফোনের সেটিং পরিবর্তন করুন
আপনার ফোনের সেটিং পরিবর্তন করুন। মোবাইলের নোটিফিকেশন সেটিং বন্ধ করে দিন। মোবাইলের নোটিফিকেশন আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এবং মোবাইল ব্যবহারের প্রতি আকৃষ্ট করে।
৮. চিন্তা-ধারা পরিবর্তন করুন
আপনার মোবাইলের প্রতি আপনার চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন করুন। চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আপনার নিজের আবেগ ও আচরণ পরিবর্তন করতে সাহায্য করতে পারে। চিন্তাভাবনার পরিবর্তন আপনাকে আপনার মোবাইল অতিরিক্ত ব্যবহার হতে দূর করতে পারে।
বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দেন আপনি মোবাইলে যা দেখতে চান তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজের সময় কোনও অহেতুক কোনও নোটিফিকেশন আসলে আগে ভেবে নিন এই মেসেজ এখনই দেখা প্রয়োজন? যদি প্রয়োজন না হয় তাহলে মোবাইল ব্যবহার হতে সে সময় বিরত রাখুন নিজেকে। ভাবুন যে, এখন কাজের সময় এই মেসেজটি দেখতে গেলে আপনার অনেক সময় নষ্ট হবে।
যে কাজ করছেন সে কাজেই শুধু মনোযোগ ও নিষ্ঠা বজায় রাখুন অন্যকোনও জিনিসেই আর লক্ষ্য করবেন না নিজের সাথে ওয়াদা করুন। আপনার বর্তমান চিন্তাভাবনা এবং প্রতিক্রিয়ায় যা হচ্ছে তার ওপর মনোনিবেশ করুন এই উদ্ব্যগ আপনার মোবাইল-ফোন ব্যবহারের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
৯. মোবাইল ব্যবহার না করে এর বিকল্প কিছু চিন্তা করুন
- আগে নিজেকে বুঝুন, ভাবুন কেনও আপনি মোবাইল ব্যবহার করে পছন্দ করেন। যদি নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে, সামাজিক অবস্থান বজায় রাখার জন্য আপনি মোবাইলে বেশীরভাগ সময় ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে আপনি সামনাসামনি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করুন মানুষের সাথে। সোশিয়াল লাইফে পরিচয় হওয়া মানুষের তুলনায় সামনাসামনি পরিচিত মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
- অন্যান্য আবেগ ও মানসিকতা সঞ্চার করার ক্রিয়াকলাপে যুক্ত হোন। মোবাইল আমরা অতিরিক্ত ব্যবহার করি শুধুমাএ নিজেদের ভালো লাগার জন্য এ ভালোলাগাটা অন্যকোনও গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপে গড়ে তুলতে হবে। ব্যায়াম, খেলাধুলা, ছবি আঁকা, সৃজনশীল কাজকর্ম করতে পারেন।
- অযথা বসে না থেকে নিজেকে ব্যাস্থ রাখার চেষ্টা করুন সবসময়। আপনি যদি চাকুরীজীবী হোন তাহলে নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিন। আর যদি আপনি বেকার হোন তাহলে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক কাজে অংশ নিতে পারেন। এছাড়া নতুন কোনও সখ তৈরি করতে পারেন যেমন: সেলাই করা, বুনন ইত্যাদি। পরিবারের সাথে দিনের বেশীরভাগ সময় কাটান, যে কাজগুলো করা প্রয়োজন তার দিকে আরও মনোনিবেশ করুন।
- আপনার ফোনের সাথে সংযুক্ত নয় এমন সবগুলো কাজের একটা লিস্ট তৈরি করুন। মোবাইল ব্যবহার করতে ইচ্ছে হলেই কাজগুলোর উপর একবার চোখ ভুলিয়ে নিয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠনমূলক কাজগুলো করুন।
- আপনার যদি মোবাইল ব্যবহারের নেশাটা গেইম খেলার কারণে হয় তাহলে, বন্ধুদের নিজের বাসায় বা প্লে গ্রাউনে ডাকুন একসাথে সবাই খেলাধুলা করতে পারেন। এমন খেলাধুলা আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখবে। কিন্তু মোবাইল গেইম আপনার চোখ ও মস্তিষ্ক দুটোরই ক্ষতি করে।
১০. কারোও কাছ হতে সাহায্য নিতে পারেন
আপনার মোবাইল অতিরিক্ত ব্যবহারের সমস্যাটি যদি অনেক বেশী হয় তাহলে কাছের কাউকে সে সম্পর্কে জানাতে পারবেন। সামাজিক বা পারিবারিক সমর্থন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। মানুষের ইতিবাচক কথাবার্তা আমাদের মাঝে অনেক ভালো প্রভাব ফেলে।
যদিও আমরা ভাবি মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক বজায় আছে কিন্তু সত্যিটা মোটেও তা না। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার আমাদের অন্য সবার থেকে দূরে ঠেলে দেয়। আপনি আপনার সমস্যাগুলো বিশ্বাসযোগ্য মানুষের কাছে শেয়ার করুন। তারা আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।
যারা আপনাকে প্রায় সময় মেসেজ করেন বা যোগাযোগ বহাল করে। তাদের জানান আপনি মোবাইল অতিরিক্ত ব্যবহার হতে বিরত রাখতে চাচ্ছেন নিজেকে তাহলে, তারা আপনাকে বিরক্ত করবেনা।
মোবাইলে যোগাযোগ করার থেকে ভালো সামনাসামনি কথা বলুন। এতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উন্নত হবে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে ইভেন্টের প্লেন করতে পারেন।
আপনার যদি অতি নেশার সৃষ্টি হয় মোবাইলের প্রতি এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটায় তাহলে, আপনি সাইক্রেটিস্টের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
পরিশেষে
এই ছিল আজকে মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আলোচনা। আশা করি, লেখাটি পড়ে উপকৃত হবে। আপনি যদি এসব মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির কৌশলগুলো অনুসরণ করেও সুফল না পান, তাহলে কমেন্ট করে আমাদের জানিয়ে দিন।