টাকা জমানো বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচলিত ধারণা। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আজকে টাকা জমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করব। অনেকে মনে করে, টাকা ইনকাম করবো, তারপর জমাবো। কিংবা অনেক বেশী টাকা ইনকাম করার পর টাকা জামানো শুরু করবো।
আপনার যদি এরকম ধারণা থাকে, তাহলে আজই এই ধারণা পরিবর্তন করুন। আজকের এই লেখা পড়লেই বুঝতে পারবেন টাকা জমানোর কৌশল সম্পর্কে। তাই, ভূমিকা বড় না করে মূল আলোচনা শুরু করা যাক।
লেখার সূচিপত্র
টাকা জমানোর উপায়
টাকা জমানোর প্রাক্কালে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে হবে:
- আপনি কিছু টাকা জরুরি ভিত্তিতে খরচের জন্য জমাতে পারেন। এর মানে এই না যে, এটি আপনি ফিউচারের জন্য জমাচ্ছেন। এই জরুরি খরচের জন্য জমানো টাকা আপনার যে কোন সময় খরচ করতে পারেন, একে বলা হয় চলিত সঞ্চয়।
- আপনি কত টাকা জমাবেন, সে অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করুন।
- কোথায় অর্থ জমাবেন তা চিন্তা করে ঠিক করুন। মানে হল, বাসায় জমাবেন নাকি ব্যাংকে জমাবেন তা ঠিক করা।
১. বাজেট করতে শেখা এবং আপনার আর্থিক অবস্থা বুঝতে শেখা
দ্রুত টাকা জমানোর জন্য আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিপসটি হল: বাজেট করতে শেখা। আপনি যদি আপনার বাজেটের নিয়ন্ত্রণে থাকেন তবে আপনি আপনার আর্থিক অবস্থাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
- টাকা জমানোর আগে আপনার মাসিক নগদ আবহের সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে,
- তারপর আপনার মাসিক খরচের একটি লিস্ট বানাতে হবে,
- এই সব খরচ মিটিয়ে যে অর্থ বাঁচবে তা জমানোর চিন্তা করতে হবে।
- প্রতি মাসে এমন কিছু খরচ থাকে যা কিনা পরিবর্তনশীল, তাই আপনার আয়ের কিছু অংশ সেই খরচের জন্য বরাদ্দ, বাকি টাকা সঞ্চয়ের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।
আপনার আয় যদি কিছুটা বাড়ে ও আপনি সেই ক্ষেত্রে আপনার সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। আপনি দরকার হলে আপনার আয় থেকে সঞ্চয়ের জন্য একটি নির্ধারিত শতাংশ ভাগ রাখতে পারেন।
২. ঋণ থেকে বেরিয়ে আসা
আপনি সঞ্চয় শুরু করার আগে, আপনাকে আপনার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধ করতে যত বেশি বিলম্ব করবেন, এটি তত বড় হয়ে উঠবে। এর কারণ হল সুদ। অর্থ ধার করার জন্য আপনি, যে মূল্য প্রদান করেন; সময়ের সাথে সাথে সুদের হার বাড়তে থাকে। তাই, টাকা জমানোর আগে আপনি আপনার সব ধরনের ধারদেনা মিটিয়ে নিন।
৩. অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করা

একজন আমেরিকান সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, টাকা জমানোর উপায় হিসাবে একটি ৫০,৩০,২০ পলিসি আবিষ্কার করেছিলেন। এর মানে হল,
- আপনার আয়ের ৫০% আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তা মিটানোর জন্য, যেমন বিদ্যুৎ বিল,পানির বিল, অন্যান্য খরচের জন্য ব্যবহার করা।
- আপনার আয়ের বাকি ৩০% আপনার নিজের চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহার করা যেমন খাবার, জামাকাপড় , ঘুরতে যাওয়া বা ঋণ মিটানো , ইত্যাদি প্রয়োজনে ব্যবহার করা।
- আর বাকি ২০% সঞ্চয় করা।
৪. সেভিংস অ্যাকাউন্ট তৈরি করা
দ্রুত টাকা জমানোর জন্য, আপনি যে অর্থ সঞ্চয় করতে চান তা থেকে আপনার প্রতিদিনের প্রয়োজনের অর্থ আলাদা করতে হবে। এর মানে একটি নির্দিষ্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট সেট আপ করা।
এটি করার মাধ্যমে, আপনি প্রতিদিনের ব্যয়গুলি কভার করার জন্য আপনার সঞ্চয়ের উপর নির্ভরশীল থাকবেন না। পরিবর্তে, আপনার জমানোর উৎসাহও বাড়বে এবং সাথে প্রতিদিনের ব্যয়ও ঠিক মত কভার হবে।
৫. আপনার সঞ্চয় স্বয়ংক্রিয় করা
আপনার যদি একটি নির্দিষ্ট মাসিক আয় থাকে এবং সেটা ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। তাহলে, প্রতি মাসে আপনার সঞ্চয় স্বয়ংক্রিয় করার বিষয়টি বিবেচনা করুন। মানে হল, কোন মাসে ব্যয় কম হলে; তার অতিরিক্ত অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার সঞ্চয়ের অ্যাকাউন্টে চলে যাবে।
৬. আপনার বিল স্বয়ংক্রিয় করা
এই বিষয়টি উপরিউক্ত বিষয়টির মতই অনেকটা। এর মানে হল আপনার ব্যয়ের তহবিল আপনার সঞ্চয়ের তহবিলের সাথে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা, আপনি যদি কোনোভাবে ব্যয় তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ না রাখতে পারেন, তাহলে সেটা আপনার সঞ্চয় তহবিল থেকে অটোমেটেড হয়ে কভার হয়ে যাবে।
৭. কার্ডে একটি ব্যয়ের সীমারেখা তৈরি করা
দ্রুত অর্থ সাশ্রয় করার জন্য আপনি আপনার ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডগুলিতে কতটা ব্যয় করতে পারেন, তার একটি সীমা সেট করুন। এটি আপনাকে অতিরিক্ত ব্যয় করা থেকে বিরত রাখে এবং আপনাকে আপনার প্রতিদিনের ব্যয় নিয়ে অগ্রিম পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করে। এখন অনেক ব্যাংক এই সেবা দিয়ে থাকে। প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বন্ধ রাখুন।
৮. খাম বাজেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা

এর মানে হল যে, আপনি খরচের টাকা একটি খামে রাখবেন। সবচেয়ে ভাল হয় খরচের বেশ কয়েকটি খাম করলে যেমন: বাসা ভাড়ার একটি খাম, খাবারের একটি খাম, চিকিৎসার একটি খাম, পোশাকের একটি খাম, বিনোদনের জন্য একটি খাম। কোন মাসে যদি একটি খামের টাকা বাকী থাকে তাহলে সেই খামটি আপনি সেভিংস খামে রেখে দিতে পারেন। সেভিংসের ২টি খাম করতে পারেন। যথা:
- অল্প মেয়াদী সেভিংস খাম: অনেক সময় জমানো টাকার প্রয়োজন হতে পারে, তখন এই খামের টাকা খরচ করবেন।
- দীর্ঘ মেয়াদী সেভিংস খাম: এটা খরচ করা যাবে না। এটা দীর্ঘ মেয়াদী সেভিংস।
এই খামগুলির প্রতিটি আপনার বাজেটের গোলের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং, আপনার নির্দিষ্ট খরচের জন্য আপনার কাছে খাম থাকবে (যেমন, ভাড়া, ইউটিলিটি বিল), এবং আপনার পরিবর্তনশীল খরচগুলির জন্য খাম (যেমন, জামাকাপড় কেনাকাটা, বাইরে খাওয়া, মুদিখানার জিনিস) থাকবে।
৯. অব্যবহৃত খাত থাকলে তা বন্ধ করে দেওয়া
অনেক সময় আমরা করি কি, ফ্যামিলি ট্যুর বা ঘুরতে যাওয়ার জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রাখি। তবে সবসময় তো আর আমরা ঘুরতে যেতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে আপনি আপনার এই অব্যবহৃত খাতের টাকা আপনার রেগুলার সঞ্চয় তহবিলে জমা রাখতে পারেন। এর ফলে আপনার ব্যয় ও সাশ্রয় হল এবং আপনার সঞ্চয়কৃত অর্থের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পেল।
১০. নষ্ট হওয়া জিনিস নিজেই ঠিক করা
কিছু জিনিস আছে, যেমন, ছেঁড়া জামা নিজে সেলাই করা, বাসায় নিজে রান্না করা, খুব দামি জায়গা থেকে কিছু না কিনে একটু সাশ্রয়ী জায়গা থেকে কিছু কেনা, ব্যাগের চেইন নষ্ট হয়ে গেলে নিজেই ঠিক করা, এর সব ছোট খাট নিজে নিজে ঠিক করার মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যয় কমানো তথা সঞ্চয় বাড়াতে পারবেন। বিদ্যুৎ বিল কমানোর উপায়?
১১. অফিসে বাসা থেকে খাবার নিন
অফিসে লাঞ্চ করার জন্য, খাবার বাসা থেকে নিয়ে যান। এতে করে, আপনার অনেক টাকা সেভ হবে, সেই সাথে স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে। ফলে, চিকিৎসা খাতে যে খরচ হয়, সেটা কমে যাবে।
১২. খোলা বাজার কিংবা পাইকারি মার্কেট থেকে কিনুন
সুপার শপে সাধারণত পণ্যের দাম বেশী থাকে। তাই চেষ্টা করুন, খোলা বাজার ও ফেরিওয়ালাদেরে থেকে পণ্য কেনার।
১৩. ভালো মানের পণ্য কিনুন
সবসময়ে চেষ্টা করবেন, ভাল মানের পণ্য কেনার। এই ধরণের পণ্যের স্থায়িত্ত্ব অনেক দিন থাকে। ফলে, বারবার কেনার ঝামেলা নেই। এছাড়া, ভাল খাবার কেনাও শরীরের জন্য ভাল।
১৪. পরিবহনে কম খরচ করুন

স্বল্প দূরত্বের জায়গাতে রিক্সা বা অন্য যানবাহন ব্যবহার বন্ধ রাখুন। এতে করে আপনার শরীর যেমন ভাল থাকবে তেমনি ভাল থাকবে আপনার মন।
১৫.প্যাসিভ ইনকাম করার চেষ্টা করুন
যাই করেন, তার পাশাপাশি কিছু ইনকামের রাস্তা তৈরি করুন। আমাদের অনলাইন আয় এই ক্যাটেগরিতে এমন অনেক লেখা পাবেন। এসব লেখা অনুসরণ করে আপনি অনলাইনে প্যাসিব ইনকাম করতে পারবেন। কিছু প্যাসিভ ইনকামের টেকনিক:
- অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং
- বই লেখা
- বাসা, গাড়ি বা অন্য যেকোন জিনিস ভাড়ায় দেয়া
- ব্লগিং করা
- ইউটিউব বা ফেসবুকে ভিডিও দেয়া ইত্যাদি
পরিশেষে
এই ছিল আজকে টাকা জমানোর উপায় নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা। আশা করি এই লেখা থেকে টাকা জমানোর কৌশলগুলো জেনে নিতে পেরেছেন।