আমরা নিশ্চয়ই বৃষ্টির পর মাঝে মাঝে আকাশে রংধনু দেখতে পাই। অপরূপ সুন্দর তা দেখতে। তো কখনো কী ভেবে দেখেছেন, এই রংধনু কেন হয় বা রংধনু কিভাবে সৃষ্টি হয়? এটা অনেকেই জানেনা আজ আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি রংধনু কিভাবে সৃষ্টি হয় তা সম্পর্কে।
শহর অঞ্চলে বর্তমানে উঁচু উঁচু দালানকোঠার জন্য রংধনুর দেখা পাওয়া ভারী মুশকিল। তবে, আপনি যদি একটানা ভারী বৃষ্টির পর বাড়ির ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন তবে রংধনুর দেখা মিললেও মিলতে পারে। তো চলুন, দেখে নিই কীভাবে এই রংধনু তৈরি হয়।
রংধনু কিভাবে সৃষ্টি হয়?
যখন বৃষ্টি শেষ হয় তার খানিকটা পর মূহুর্তেই আকাশে দেখা দেয় রংধনুর রং এর বাহার। কিন্তু এটা আসে কোথা থেকে?
যখন বৃষ্টি হয় বা তার আগ মুহুর্তে তখন বাতাসের মাঝে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে বাতাসে জলীয় বাষ্প সবসময় একটু না একটু থাকেই। তো, বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে প্রচুর পানি পড়ে, যা মেঘ কর্তৃক আসে। এরপর যখন বৃষ্টি শেষ হয়, তখন কিন্তু এই পানি সম্পূর্ণ রূপে নিচে নেমে আসে না। কিছু পানি আকাশেই রয়ে যায়।
সেটা আমরা দেখতে পারিনা। এটা বাতাসের সাথে মিশে যায় (আর এই কারনেই কিন্তু বৃষ্টির পরের সময়ের বাতাসটুকু অনেক ঠান্ডা থাকে)। তাই বাতাসে তখন জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি অনেকটা বেশি থাকে। এই জলীয় বাষ্পটা বৃষ্টির কণা হিসেবে পরিচিত। কারণ, বৃষ্টির পরই ছোট বৃষ্টির ফোঁটাগুলো একসময় বাতাসে মিশে, সেখানে জলীয় বাষ্পের পরিমান বৃদ্ধি করে।
এরপর বৃষ্টি শেষে যখন সূর্যের দেখা মিলে; তখন আকাশ থেকে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে নেমে আাসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চলার পথে সকল কিছুই বাধা প্রদান করে। আপনি যদি চলতে থাকেন, পথে আপনার সামনে দেয়াল পড়লে আপনি আর সামনে এগোতে পারবেন না।
ঠিক একই কারনে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে নেমে আসতে বাঁধা পায়। কারণ, তখন বৃষ্টির কণা বা জলীয় বাষ্প মিশ্রিত সে বাতাস একটু ভারী থাকে। আর সূর্য যখন তা ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে, তখন সে আলো সমানভাবে আসতে পারে না। তার প্রতিসরন ঘটে। এই প্রতিসরিত আলোটুকু থেকেই সৃষ্টি হয় রংধনুর। কারন, সূর্য থেকে যে আলোটুকু প্রতিসরিত হয় তা সৃষ্টি করে বর্ণালীর। এই বর্ণালীকেই আমরা রংধনু নামে চিনি।
প্রতিসরণ কী?
এখানে আপনাদের মনে প্রতিসরণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে। এখানে তাও বলে দেই। একটি আয়নার সাহায্যে উদাহরণ দেই। আপনি একটি কাচের স্বচ্ছ আয়নার উপর আলো ফেললেন৷ এখানে আলোর তিনটি দিক দেখতে পাবেন।
- প্রথমত সেখানে আপনি একটু বাঁকা করে আলোটা ফেলার পর একটু আলো আয়নায় ধাক্কা খেয়ে আবার কোণ করে ফিরে আসবে। এটা প্রতিফলন।
- একটু আলো আয়নায় বিলীন হয়ে যাবে, এটা শোষন।
- আর অন্য আলোটুকু আয়নার ভেতরেই প্রবেশ করবে। এই আলোটুকু আপনি যে আলোটা ফেলেছেন সেখন থেকেই ভেতরের দিকে চলে যাবে সমান্তরালে। এটাই আলোর প্রতিসরণ।
আলো এখানে প্রথম থেকে দ্বিতীয় মাধ্যমে যায়। একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই বিষয়টি আপনি আন্দাজ করতে পারবেন।
রংধনু অর্থ?
রংধনু অনেকগুলো (সাতটি) রং। এই রং এর সমাহার এর জন্য প্রথম নাম রং। এর সাথে এটি দেখতে ধনুকের মতো বাঁকা (তীর ধনুকের ধনুক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন) এ কারনেই এর নাম রং + ধনু = রংধনু। রংধনুতে সাাতটি রঙের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এগুলো হলো- বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল। এদেরকে সংক্ষেপে বলা হয় বেনীআসহকলা।
বর্ণালির রং গুলো?
রংধুনর রং ই বর্ণালির রং। বে-নী-আ-স-হ-ক-লা। এই নামটি রংগুলোর প্রতিটি থেকে তাদের প্রথম অক্ষর নিয়ে তৈরি। আর আকাশে যখন আমরা রংধনু দেখতে পাই তখন এই রং এর ধারাবাহিকেই আমরা রংধনু দেখি।
রংধনু সৃষ্টি হওয়ার শর্ত কী?
রংধনুর সৃষ্টি হওয়ার জন্য কেবল একটি বিষয়ের দিকে ক্লিয়ারলি লক্ষ করতে হবে। অনেক সময় বৃষ্টি হয়, আমরাও বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর উদাস মনে আকাশের দিলে তাকিয়ে থাকি রংধনু দেখব বলে। তবে সূর্যের দেখা মিললেও, রংধনুর দেখ মিলে না।
এর কারণ দুপুর হওয়া। আপনি যদি কখনো দুপুরের সময়, মানে ৩ টা বা তার কাছাকাছি সময়ে নয়, ১২ টার একটু আগে পিছে যখন সময় থাকে। তখন সূর্য থাকে পুরোপুরি মাথার উপর। আর এ কারনেই আমরা তখন রংধনুকে দেখতে পাই না।
কারণ, সূর্য যদি সরাসরি মাথার উপর থেকে তীর্যক ভাবে আলো দেয় তখন রংধনুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। তাই সূর্যকে অবশ্যই অ্যাঙ্গেলে থাকতে হবে। মানে একটু বাঁকানো থাকতে হবে। তবেই কেবল রংধনু দেখা যাবে।
আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি তা হলো প্রতিসরন। আর সূর্য যদি মাথার উপর অবস্থান করে তবে তার প্রতিসরন হয় না। আমরা মানুষ, আমাদের চলার জন্য মাধ্যমের দরকার। তবে আলোর তা দরকার নেই। তবে আলো যখন পৃথিবীতে প্রবেশ করে, তখন তা ধুলা – বালি, জলীয় বাষ্প অনপক কিছু ভেদ করে আসে। আর সূর্য একদম মাঝখানে অবস্থান করলে আলো কোনো বাধা পায় না৷ তাই প্রতিসরণও হয় না। আর রংধনুও তাই দেখা যায় না।
কীভাবে ধনুকের আকার নেয়?

এটা অনেকের কাছে মনে হতে পারে স্বাভাবিক একটি বিষয়। তবে এর পেছনেও কিছু কারণ থাকে। বেগুনি থেকে শুরু করে লাল রং পর্যন্ত যে সাতটি রং আকাশে দেখা যায়, তার প্রতিটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিষয়টি না বুঝতে পারলে লিঙ্কে গিয়ে পড়ে আসতে পারেন।
এই প্রতিটি রং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে এক একটি রং এক এক ভাবে বেঁকে যায়। কোনো রং এরই তরঙ্গদৈর্ঘ্য পুরোপুরি এক হয় না।
- এই রংধনুতে উপস্থিত বেগুনি রং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০°।
- আর লাল রং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪২°।
তাহলে, এই দুইটি রঙের ডিগ্রির পরিমাণ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে নির্ধারণ করলে যেরকম হিসাব দাঁড়ায় সেটুকু চিকন হয় রংধনু।
আর বাকি যে রং গুলো আছে,
- নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা। এই ৫ টি রং এর মাঝে সবুজ রং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪১°।
- নীল ও আসমানী রং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০° থেকে ৪১° এর মধ্যে।
- আর হলুদ ও কমলা রং এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪১° থেকে ৪২° এর ভেতরে।
তাই এই রংগুলো একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রে জুড়ে থাকে। সাথে ৪২° পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্য হওয়ায় এটি ধনুকের মতো বেঁকে থাকে। আপনি যদি জ্যামিতি বক্সের চাঁদায় ৪০° থেকে ৪২° পরিমাপ করতে যান তাহলে, ধনুকের বিষয়টি বুঝতে পারবেন আরো পরিষ্কারভাবে।
গৌন রংধনু
আকাশে রংধনু উঠলে যে বিষয়টা অনেক চমকপ্রদ তা হলো, রংধনু আকাশে উঠলে তা একাই অবস্থান করে না। এই বিষয়টি অনেক মানুষ জানেন না। এই মূল রংধনুর উপর আরও একটি রংধনুর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তখন ওই রংধনুটি মূল রংধনুর উল্টো থাকে। মানে রংগুলো থাকে বিপরীত ক্রমে সাজানো সাথে ধনুকের চিহ্নটিও কখনো উল্টো।
এই রংধনুটিকে কেউ কেউ প্রতিচ্ছবিও বলে থাকেন মূল রংধনুর আলোকে মানে পরিপ্রেক্ষিতে। এই রংধনুকে বলে গৌন রংধনু। মূল রংধনু ও গৌন রংধনুর মধ্যকার আকাশ খানিকটা অন্ধকার হয়। তবে আকাশ খুব বেশি পরিষ্কার থাকলে এটি সহজেই দেখা যায়, আবার কখনো কখনো সূর্যের তাপের কারনে চোখ এড়িয়ে যায়।
রংধনু কয়টি রং?
৭টি যথা: বেগুনী, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল।
রংধনু কখন দেখা যায়?
বৃষ্টির পরে আকাশে সূর্যের উল্টা পাশে মানে বিপরীত পাশে দেখা যায়।
পরিশেষে
এই লেখায় রংধনুর প্রতিটি বিষয় নিয়ে সহজভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি আজকের এই লেখা থেকে রংধনু কিভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে অনেক কিছু বিস্তারিতভাবে জানতে পারলেন।