সিঙ্গাপুরক দেশটার নামতো কমবেশি সবাই শুনেছেন কিন্তু সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অজানা তথ্য গুলো কি আপনি জানেন? সিঙ্গাপুর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আকাশচুম্বী ভবন, নাইটলাইফ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সুন্দর স্থাপত্য সিঙ্গাপুরকে পৃথিবীর কাছে উপভোগ করার মত একটি স্থান হিসেবে অনন্য করে তুলেছে।
সিঙ্গাপুর একটি বিশাল শহর এবং দেশ যার ইতিহাস এবং স্থান থেকে অনেক কিছু জানার আছে। ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভ করা এই দেশটির একজন মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় ৪৮ লক্ষ টাকা! এরকম একটা দেশের অনেক তথ্যই তো আমাদের অজানা থাকবে তাই না! তাহলে, আসুন জেনে নেওয়া যাক, সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অজানা তথ্য।
লেখার সূচিপত্র
সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অজানা তথ্য
১. সিঙ্গাপুরের প্রতীক মার্লিয়ন
এই প্রতীকের মাথা হল একটি সিংহের মত, শরীর একটি মাছের মত। এক কথায় এই, এর হাফ সিংহ আর হাফ হল মাছ। শুনতে অবাক লাগলেও, এটি সিঙ্গাপুরের প্রতীক এবং সরকারী মাসকট, এটি কোন ‘বাস্তব’ পৌরাণিক প্রাণী নয়।
১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ ইচথিয়োলজিস্ট অ্যালেক্স ফ্রেজার-ব্রুনার সিঙ্গাপুর ট্যুরিজম বোয়ার জন্য এটি ডিজাইন করেছিলেন। মাছটি সিঙ্গাপুরের মাছ ধরার ঐতিহ্যকে তুলে ধরে তার সাথে তেমাসেক নামে একটি মাছ ধরার গ্রামকে ও উপস্থাপন করে, যা পরে সিঙ্গাপুরা বা ‘লায়ন সিটি’ নামকরণ করা হয়।
২. বিশ্ব টয়লেট অর্গানাইজেশন
২০০১ সালের ১৯ শে নভেম্বর সিঙ্গাপুরে একটি টয়লেট অরগানাইজেশন গঠিত হয়। এর ফলে ১৯ নভেম্বরকে ‘বিশ্ব টয়লেট দিবস’ করার প্রস্তাব দেয়। ১২২টি দেশ এই ধারণাকে সমর্থন করে এবং বিশ্ব টয়লেট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) শুরু হয়। এটি আসলেই দুর্দান্ত একটি ব্যাপার। যার মাধ্যমে প্রত্যেকের জন্য পরিষ্কার, নিরাপদ টয়লেট সরবরাহ করে বিশ্ব স্যানিটেশন সংকট সমাধান করা হয়।
৩. বেত্রাঘাতের প্রথা
যদিও বেত্রাখাত একটি ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশ প্রথা ছিল, তবে সিঙ্গাপুরও একটি ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল; বেত্রাঘাত তখনকার মালয় এবং স্ট্রেইট সেটেলমেন্টে প্রবর্তিত প্রথাগুলির মধ্যে একটি ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল সিঙ্গাপুর।
কেবলমাত্র ভাংচুরের জন্য নয়, বরং যৌন নির্যাতন, দাঙ্গা এবং মাদকের অপব্যবহারের জন্য শাস্তি হিসেবে বেত্রাঘাত করা হয়। বেত্রাঘাত পুরুষদের উপর প্রয়োগ করা হয়, নারীরা এর থেকে বেঁচে গেছে। যারা অন্যায় করে তাদের নিতম্বের উপর বেত্রাঘাত করা হয়। নিতম্ব কি বুঝতে পেরেছেন? না বুঝলে কমেন্ট করে জানিয়ে দিন?
৪. ১-২ বছরের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগের নিয়ম
এটা ঠিক। সিঙ্গাপুর তার প্রতিবেশী দেশ থেকে আক্রমণের বিষয়ে বেশ ভীত থাকে। তাই ১৯৬৭ সালের ১৫ ই মার্চ, সিঙ্গাপুরের ১৮ বছর বয়সী সকল পুরুষ নাগরিকের পাশাপাশি স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়।
সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অজানা তথ্যর মধ্যে এটিও একটি অজানা তথ্য আশা করি। যে, এখানে সেনাবাহিনীতে ১ বা ২ বছরের জন্য থাকতে হবে।
৫. নিজস্ব উপভাষা
সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন ভাষার প্রচলন আছে। এর চারটি দাপ্তরিক ভাষা হল
- ইংরেজি
- চীনা
- মালয়
- তামিল
যদিও বেশিরভাগ সিঙ্গাপুরবাসী যে কোন একটি ভাষায় কথা বলতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই এসব ধরনের ভাষার সংমিশ্রনে একটি উপভাষা প্রচলিত আছে যাকে বলা হয় সিংলিশ। এটি একটি চমত্কার জটিল ইংরেজি-ভিত্তিক উপভাষা, যা জোর দেওয়ার জন্য লাহ দিয়ে বাক্যগুলি শেষ করে দেয়।
৬. লোকাল খাবার
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে মজার বিষয় হল, যেকোন লোকাল খাবার হকার স্ট্যান্ডে খাওয়া যায়। সিঙ্গাপুরের রন্ধনপ্রণালী অবাস্তব। এইখানের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে, লর মি এবং হাইনানিজ চিকেন, ভারতীয় থালি সেট, নাসি গোরেং এর মতো মালয় ডিশ।
সিঙ্গাপুর এক কথায় ফুড কোর্টের জন্য নিবেদিত একটি শহর, এর মধ্যে চায়না কমপ্লেক্স টাউন বিখ্যাত এইখানে প্রায় ২৬০ টি ফুড স্টল রয়েছে। বাংলাদেশের নিউমার্কেটের কিংবা ফার্মগেটের ফুটপাতের খাবার খেয়ে যাদের পেট খারাপ হয়ে যায়। তারা কিন্তু সিঙ্গাপুরের ফুটপাতে গিয়ে ভরপুর খেতে পারবেন, পেট খারাপ হওয়ার সম্ভবণা খুব কম।
৭. রাতের বেলায় রেসিং
২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর সিঙ্গাপুরে গ্র্যান্ড প্রিক্স সিজন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ফর্মুলা ওয়ান ভক্তদের জন্য এবং সমস্ত বয়সের দর্শকদের জন্য কনসার্ট, রেসিং এবং বিনোদন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা হয়।
স্টার ইভেন্ট – ফর্মুলা ১ সিঙ্গাপুর গ্র্যান্ড প্রিক্স – বিশ্বের প্রথম ফর্মুলা যেখানে রাতের বেলা রেসিং ইভেন্ট করা হয়, যা একটি ইতিহাস তৈরি করেছে।
৮. মনুষ্যসৃষ্ট জলপ্রপাত
মান্দাই ওয়াইল্ডলাইফ রিজার্ভের মতে, ১৯৭১ সালে জুরাং বার্ড পার্কে প্রথম মনুষ্যসৃষ্ট জলপ্রপাতটি নির্মিত হয়েছিল। ৩০ মিটার উচ্চতা থেকে নেমে, এটি এখন পর্যন্ত একটি এভিয়ারির সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত বলে মনে করা হয়। সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অজানা তথ্যর মধ্যে এটিও একটি।
৯. নাইট সাফারি
সিঙ্গাপুরের নাইট সাফারি এমন এক অ্যাডভেঞ্জার অভিজ্ঞতা প্রদান করে, যা আর অন্য কোথায়ও করা হয় না। এটি বিশ্বের প্রথম রাতের চিড়িয়াখানা। ১৯৯৪ সালে ৩৫ হেক্টর জমি নিয়ে এই পার্ক খোলা হয়। এখানে বর্তমানে ১,০০০ এরও বেশি প্রাণী আছে। যারা তাদের মত করে প্রাকৃতিকভাবে রাতে সময় কাটাতে পারে।
১০. ৬৪ অফশোর দ্বীপপুঞ্জ
সিঙ্গাপুরের ভূমি এলাকায় প্রায় ৬৪ টি অফশোর দ্বীপ রয়েছে যা মূল দ্বীপটিকে ঘিরে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে সেন্টোসা (অফশোর দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম), পুলাউ উবিন, সেন্ট জনস আইল্যান্ড এবং সিস্টারস দ্বীপপুঞ্জ।
১১. সবুজ নগরী
আকাশচুম্বী এই শহরটিও সবুজে পরিপূর্ণ। সিঙ্গাপুরের প্রায় অর্ধেক ভূমি (প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার) সবুজ আবরণের আওতায় রয়েছে। অসংখ্য পার্ক এবং বাগান ছাড়াও, এমন অনেক নাম না জানা উদ্ভিদ আছে যা দিয়ে পার্ক বা বাগানগুলো সাজানো হয়। যেমনঃ পিকারিং এর গার্ডেন, ক্যাসকেডিং উল্লম্ব বাগান।
সিঙ্গাপুরে ২,১০০ টিরও বেশি স্থানীয় ভাস্কুলার উদ্ভিদের প্রজাতি রয়েছে। বিশেষ করে বুকিত তিমাহ নেচার রিজার্ভে বলা হয়। উত্তর আমেরিকায় মোট যে পরিমাণ গাছ পাওয়া যায়। তার চেয়ে এই খানে এক হেক্টর জমিতেই অনেক প্রজাতির গাছ রয়েছে।
১২. ব্রিটিশরা আবিষ্কার করে এই দেশটি
সিঙ্গাপুরার শেষ রাজা চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে আক্রমণ করার পরে পালিয়ে যান। এমন প্রমাণ রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে পুরো জায়গাটি পরিত্যক্ত ছিল। ১৮১৯ সালে স্যার স্ট্যামফোর্ড রাফেলস এই পরিত্যক্ত জায়গাটি আবিস্কার করেন, যা বর্তমানের সিঙ্গাপুর।
১৩. শহর রাষ্ট্র
সিঙ্গাপুরের কোন রাজধানী নেই, যেহেতু এটি একটি শহর-রাষ্ট্র এবং এমন একটি দেশ যা আক্ষরিক অর্থেই একটি শহর। অন্য দুটি শহর রাষ্ট্র হল সান মারিনো, এবং ভ্যাটিকান সিটি।
১৪. ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট
সিঙ্গাপুর ২০১৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে প্রশংসিত হয়। এছাড়া ও এইখানের বোটানিক গার্ডেনের ১৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইতিহাস রয়েছে; এটি আধুনিক সিঙ্গাপুরের চেয়ে এক শতাব্দীরও বেশি পুরানো!
এর সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণ হল ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেন, যেখানে হাজার হাজার অর্কিড গাছের প্রজাতি রয়েছে যা ভিআইপি উদ্ভিদ (ভিআইপি) নামে পরিচিত। নেলসন ম্যান্ডেলা, ডিউক এবং ডাচেস অফ কেমব্রিজের মতো বিদেশী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি অভিনেতা জ্যাকি চ্যান, ঝাউ জুন এবং বে ইয়ং জুনের মতো সেলিব্রিটিদের সাথে সাক্ষাতের পরে এই উদ্যানের ২০০ টিরও বেশি হাইব্রিড অর্কিডের নামকরণ করা হয়েছে।
১৫. টন অফ-দ্য-বিটড ট্র্যাক প্রতিবেশী
চায়নাটাউন, কামপং গেলাম এবং লিটল ইন্ডিয়ার ইতিহাস সমৃদ্ধ হটস্পটগুলি ছাড়াও, সিঙ্গাপুরে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখার জন্য অনেক রঙিন ছিটমহল রয়েছে।
আপনি তিওং বাহরু এর আর্ট ডেকো-স্টাইলের ভবনগুলি(জায়গার নাম) বরাবর হিপ খাবারের সারি এবং স্টোরগুলি(লোকাল ফুড) পাবেন, পাশাপাশি জু চিয়াট / কাটং-এ রঙিন শপহাউস এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্টলগুলি পাবেন।
১৬. উৎসবের নগরী
সিঙ্গাপুরে সারাবছর কোন না কোন ইভেন্ট যেমনঃ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলার ইভেন্ট, জীবনযাত্রা বা আর্ট ইভেন্ট, এসব লেগেই থাকে, যার জন্য একে বলা হয় উৎসবের নগরী।বার্ষিক এইচএসবিসি ওয়ার্ল্ড রাগবি স্পোর্টস হাবে হোস্ট করা হয়।
জুলাই মাসে, খাদ্যরসিকরা সিঙ্গাপুর ফুড ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে পারে; যেখানে তারা সিঙ্গাপুরের খাবারের পাশাপাশি মড-সিন (আধুনিক সিঙ্গাপুরীয়) রন্ধনপ্রণালীর সেরা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। যা খাবারগুলিতে অন্য রকম স্বাদ জুড়ে দেয়।
১৭. জাতীয় সংগীতের নোট
সিঙ্গাপুরের ব্যাংকনোটগুলিতে সিঙ্গাপুরের পুরো জাতীয় সংগীত ছাপানো হয়।
১৮. ক্রিস্মাস দ্বীপ
যে দ্বীপগুলি সিঙ্গাপুরের অংশ ছিল তার মধ্যে একটি ছিল, ক্রিসমাস আইল্যান্ড। এই দ্বীপে অনেক নারকেল কাঁকড়া আছে। ১৯৫৮ সালে দ্বীপগুলো অস্ট্রেলিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। একইভাবে, কোকোস দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপপুঞ্জটি ১৯৫৫ সালে স্থানান্তরিত হয়।
১৯. নির্বাচন
বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, পিপলস অ্যাকশন পার্টি (পিএপি) – প্রথম নির্বাচনের পর থেকে প্রতিবারই ভোট পেয়ে এসেছে। পিএপি ভাল লোক মনে হয়। নেহাত ভাল মানুষ না হলে কি আর ভোট পায়! ভালো মানুষ চেনার উপায় নিয়ে লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন, আপনারাও ভাল মানুষ চিনতে পারবেন।
২০. গরম আবহাওয়া
সিঙ্গাপুরে বেশিরভাগ সময় গরম থাকে, সিঙ্গাপুর বিষুবরেখা থেকে ১০০ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত। এটি ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট জলবায়ু সম্বলিত এলাকা। কোনো ঋতু নেই। এখানের তাপমাত্রা সর্বদা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৭৭ থেকে ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর মধ্যে থাকে।
২১. বড়লোকের শহর
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মিলিয়নেয়ার থাকতে পারে, তবে সিঙ্গাপুরে সর্বোচ্চ শতাংশ রয়েছে। প্রতি ছয়টি পরিবারের মধ্যে একটিতে কমপক্ষে $১ মিলিয়ন ডিসপোজেবল সম্পদ রয়েছে। তাহলে বলা যায় সিঙ্গাপুর বড়লোকের শহর।
পরিশেষে
এই ছিল আজকে সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অজানা তথ্য। এই লেখাটির অনেক তথ্যই হয়তো আজকে আপনি নতুন জানলেন! তো, কোন তথ্যগুলো নতুন জানলেন কিংবা আগে জানা ছিল তা কমেন্ট করে জানাতে পারেন।